চোখের পানিতে ফাদার মারিনো রিগনকে শেষ বিদায়

রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় মংলায় সমাহিত করা হয় ফাদার মারিনো রিগনকে

চোখের পানিতে ফাদার মারিনো রিগনকে শেষ বিদায়

বাগেরহাট প্রতিনিধি

অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী বাগেরহাটের মংলার মাটিতে সমাহিত করা হলো বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ইতালির নাগরিক ফাদার মারিনো রিগনকে। আজ রোববার বিকেলে মংলার শেলাবুনিয়ায় সেন্ট পলস গির্জার পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে সমাহিত করা হয়েছে। মৃত্যুর এক বছর পর আজ ভোরে সরকারিভাবে ফাদার রিগনের মরদেহ ইতালি থেকে বাংলাদেশে আনা হয়।

রোববার ভোরে তার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে ফাদার মারিনো রিগনের মরদেহ ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌছায়।

সেখান থেকে হেলিকপ্টারযোগে তার মরদেহ বাগেরহাটের মংলায় পাঠানো হয়। সকাল ৯টা ৪৮মিনিটে তার কফিনবাহী হেলিকপ্টারটি মোংলার শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামে অবতরণ করে। ফাদার রিগনের কফিনটি গ্রহণ করেন খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক ও বাগেরহাট জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস। মোংলা উপজেলা পরিষদের মাঠে ফাদার মারিনো রিগনের কফিনে সর্বস্তরের মানুষ শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
সেখানে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। দুপুরে ফাদার মারিনো রিগনের প্রতিষ্ঠিত সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয় এবং সেন্ট পলস হাসপাতালে মরদেহ নেওয়া হলে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীসহ হাজারো অনুরাগীরা কফিনে শেষ শ্রদ্ধা জানায়। ইতালি থেকে ধর্ম প্রচারের জন্য এসে জীবনের বেশিরভাগ সময় মংলায় কাটিয়ে দেওয়া এ মানুষটিকে শেষ বিদায় জানাতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসে হাজারো মানুষ। এ সময় সেখানে হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।

news24bd.tv

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফাদার মারিনো রিগন। সংগৃহীত ছবি
 
রোববার বিকেলে ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে সেন্ট পলস গির্জার পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ফাদার মারিনো রিগনকে সমাধিস্থ করার সময়ে উপস্থিত ছিলেন তার কফিনের সঙ্গে ঢাকা থেকে মংলায় আসা ইটালির রাষ্ট্রদূত মিস্টার মারিও পালমা, ইটালিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা ইকবাল আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল বীর প্রতীক সাজ্জাত আলী জহির, সচিব নমিতা হালদার, খুলনা সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগ দুইয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সুডানা ইকরাম চৌধুরী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিফ প্রোটকল অফিসার মোনতাসির, ঢাকার ফার্মগেট চার্চের ফাদার মাই লিলিয়ান, মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব জহিরুল ইসলাম, উপসচিব আসাদুল ইসলাম, বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার সুলাইমান হোসেন, বাগেরহাট জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস ও পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায় প্রমুখ।

news24bd.tv

মংলায় হেলিকপ্টার থেকে নামানো হচ্ছে ফাদার মারিনো রিগনের মরদেহবাহী কফিন।

ইতালির নাগরিক ফাদার রিগন ১৯২৫ সারের ৫ ফেব্রুয়ারি সে দেশের ভেনিসের অদূরে ভিল্লাভেরলা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। ভিল্লাভেরলা গ্রামে বাবা রিকার্ডো এবং মা মনিকার আট সন্তানের মধ্যে বড় ছিলেন মারিনো। তাঁর জীবিত ভাইবোন এবং তাঁদের ছেলেমেয়েদের কাছে মারিনো একজন অতিশয় প্রিয় এবং ভালোবাসার মানুষ। মাত্র ২৮ বছর বয়সে খৃষ্ট্রধর্ম প্রচারে জন্য ১৯৫৩ সালের ৭ জানুয়ারী তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় আসেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি গোপালগঞ্জের বানিয়ারচর গির্জায় ছিলেন। ফাদার রিগন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় অসুস্থ ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় ও সেবা প্রদানের পাশাপশি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। দেশের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেশ স্বাধীনের পর তিনি বাগেরহাটের মংলার শেহলাবুনিয়ায় স্থায়ী আবাস গড়ে তোলেন। ফাদার রিগনকে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৯ সালে সরকার Friends of Liberation War Honour পদকসহ বাংলাদেশের সম্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রদান করে। ফাদার রিগন মংলায় থাকাবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চলাচলের শক্তি হারিয়ে ফেলেন। এরপর ২০১৪ সালে তার ভাই মংলায় এসে তাঁকে ইতালিতে নিয়ে যান। তবে শর্ত ছিল ইতালিতে গিয়ে মৃত্যু হলে তাকে মংলার সেন্ট পলস্ গির্জার পাশে সমাহিত করতে হবে। শর্ত মানায় তিনি চিকিৎসার জন্য ভাইয়ের সঙ্গে ইতালি যেতে রাজি হন।

news24bd.tv

লাল-সবুজের পতাকা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ফাদার রিগনের কফিন।

গত বছরের ২০ অক্টোবর ৯৩ বছর বয়সে ইতালির ভিল্লাভেরলা গ্রামে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধৃ ফাদার রিগন। ২৪ অক্টোবর গ্রামেরই একটি ক্যাথলিক গির্জায় তার শেষকৃত্য হয়। এ সময় তার কফিনটি ঢেকে দেওয়া হয় লাল-সবুজের পতাকায়। তিনি ইতালীয় পরিচয় রেখে বাংলাদেশি পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করতেন।

অসুস্থ অবস্থায় ভাইবোন এবং আত্মীয়-পরিজনকে প্রায়ই স্মরণ করিয়ে দিতেন তিনি সমাহিত হবেন শেহলাবুনিয়ার সাধু পলের গির্জার সামনে। তাঁর পরিবার একটি বছর সময় নিয়েছে ঐকমত্যে পৌঁছাতে। অবশেষে রিগনের শেষ ইচ্ছার কাছে তারা হার মেনেছে। ২০১৭ সালের ২০ অক্টোবর ছিল তাঁর অন্তিম প্রয়াণ। ঠিক এক বছর পর ২০ অক্টোবর ২০১৮ সালে তিনি যাত্রা শুরু করেন বাংলাদেশের মংলা উপজেলার শেহলাবুনিয়া গ্রামের উদ্দেশে। কফিনবন্দী হয়ে ফিরেছেন এবার ফাদার রিগন। এসেছেন প্রিয় ভূমিতে সমাহিত হতে!

news24bd.tv

ফাদার রিগনের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানায় সর্বস্তরের মানুষ

ফাদার মারিনো রিগন দীর্ঘ সময় মংলায় অবস্থানকালে ইতালিয়ান ভাষায় অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলিসহ ৪০টি কাব্যগ্রন্থ, লালন সাঁইয়ের তিনশত পঞ্চাশটি গান, জসীম উদ্দীনের নকশী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট ছাড়াও এদেশের খ্যাতিমান কবিদের অসংখ্য কবিতা। অন্যদিকে ফাদার রিগন বাগেরহাট জেলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়, সেন্ট পলস হাসপাতালসহ প্রতিষ্ঠা করেন ১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নারীদের কর্মসংস্থানের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন সেন্ট পলস সেলাই শিক্ষা কেন্দ্র, যেখান থেকে মেয়েদের সেলাই করা নকশিকাঁথা রপ্তানি করা হতো বিদেশে। ফাদার রিগন শিক্ষা উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’র সভাপতি সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস রিগন সম্পর্কে বলেন, তিনি ইতালিতে বাংলাদেশের অঘোষিত রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর সেন্ট পলস উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ফ্রান্সিস সুদান হালদার বলেন, ফাদার রিগন নিজেই বলতেন ‘আমার মস্তকে আছে রবীন্দ্রনাথ- অন্তরে রয়েছে লালন। ’

সম্পর্কিত খবর