'তিনটি ছেলে পিছু নিয়েছিল, একজন জাপটে ধরে'

শায়মা খালিল, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের নিউজডে’র উপস্থাপক।

'তিনটি ছেলে পিছু নিয়েছিল, একজন জাপটে ধরে'

নিউজ টোয়েন্টিফোর ডেস্ক

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সর্বশেষ ট্রেন্ডিং হ্যাশট্যাগ ‘মি টু (#metoo)’। এই  ক্যাম্পেইনে যৌন নিগ্রহের বেদনাদায়ক অনুভূতি, যা কাউকে এত দিন বলা হয়নি, তা অকপটে তুলে ধরছেন নারী-পুরুষ।  আর এতে অভিযোগের তীর উঠছে অনেক খ্যাতিমান মানুষের দিকেও। প্রথম প্রথম কিছুটা সংকোচ হয়ত ছিল, কারণ অনেকেই এ ক্যাম্পেইনে নাম লেখাতে দেরি করেছেন।

তবে এখন অকপটেই নিজের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাগুলো সামনে আনছেন সবাই। বিশেষ করে ঢের ঢের সেলিব্রেটি জানিয়েছেন তাদের যৌন হয়রানির অভিশপ্ত অভিজ্ঞতার কথা। এবার নিজের এমন এক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের নিউজডে’র উপস্থাপক শায়মা খালিল।

মিশরে বেড়ে ওঠা শায়মা খালিল জানিয়েছেন, তিনি যেখানে বেড়ে উঠেছেন সেখানে প্রতিনিয়ত যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন মেয়েরা।

অসংখ্য কিশোরী মনের গভীরে কষ্ট নিয়ে বেড়ে ওঠে। কাউকে জানতেও দেয় না তার সঙ্গে কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটে গেছে।  ভেতরে ভেতরে কুকড়ে যায়। মেয়েদেরকে ঘরের মধ্যেই থাকতে হয় সবসময়। বাইরে যেতে হলে পরিবারের কোন বড় মানুষকে অবশ্যই সঙ্গে থাকতে হবে। সেখানে কেউ উত্যক্ত করলে, যৌন হয়রানি করলে তার প্রতিবাদও করা যায় না। তাতে উল্টো বাড়িতে বকা শুনতে হয়। নিজের তেমনই এক অভিজ্ঞতার কথা যা এতদিন শুধু মনের মধ্যেই ক্ষত হয়ে জিইয়ে ছিল তা জানিয়েছেন শায়মা খালিল। তাঁর বক্তব্যে পুরো লেখাটি তুলে ধরা হল-

''১১ বছর বয়সে একটি নির্দিষ্ট দিনের কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে। আমি আমার নানির বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। একদিন প্রথমবারের মত এক বোন ও তাঁর বান্ধবীর সঙ্গে বাইরে যাওয়ার অনুমতি পাই। আমাদের সঙ্গে কোনো বড় মানুষ থাকবে না। তিনটি কিশোরী একা একা বাইরে যাবে, যা ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর দিন।

বের হওয়ার আগে আমার নানি কড়া ভাষায় সতর্ক করে দিলেন, ‘সতর্ক থাকবে, খুব বেশি দূরে যাবে না। আর ফালতু জিনিস কিনে পয়সা খরচ করবে না। ’ নানি আসলে আমাদের আইসক্রিম কিনতে বারণ করছিলেন। আমাদের খুব মজা লাগছিল। কারণ আইস ক্রিম তো আমরা খাবই। আমি খুবই উত্তেজিত ছিলাম সেই সঙ্গে কিছুটা ভীতও।

অতঃপর গ্রীষ্মের এক ব্যস্ত দিনে আলেকজান্দ্রার রাস্তায় প্রথম ‘একা’ বের হলো তিন কিশোরী।

হেঁটে যাচ্ছিলাম, বুঝতে পারিনি কেউ আমাদের অনুসরণ করছে। হঠাৎই তিনটি ছেলে আমাদের কাছে এল। তাদের একজন আমাকে জাপটে ধরল। আমি যা করলাম, নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত বোন ও বন্ধুর সঙ্গে হাঁটতে থাকলাম। কিন্তু তারা আমাদের পিছু ছাড়ল না। আমাদের ঠিক পেছনেই তারা আসতে থাকল আর উত্ত্যক্ত করতে থাকল। খুব ভয় লাগছিল সেই সঙ্গে উঠেছিল রাগও। এই তিন অসভ্য ছেলে দিনটিই মাটি করে দিল। এটিই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দিন।

আর সহ্য করতে পারলাম না, ঘুরে দাঁড়ালাম এবং চিৎকার কলে বললাম, ‘যথেষ্ট হয়েছে’। তাদের একজন আমার কথার প্রতিধ্বনি করে উপহাস করল। অসম্ভব কষ্ট লেগেছিল।

তবে তার চেয়েও বেশি কষ্ট পেলাম বাসায় ফিরে। এই ঘটনা জানানোর পর আমার মা রাগে ফেটে পড়লেন। রাগটা ওই ছেলেগুলোর ওপর ছিল না। রাগটা ছিল আমার ওপর। চিৎকার করে তিনি বললেন, ‘তুমি তার সঙ্গে কথা বলেছ? উত্ত্যক্তকারীর সঙ্গে কথা বলা তোমার উচিত হয়নি। তোমার কেবল সরে আসা উচিত ছিল। তুমি কথা বললে, ঝগড়া করলে উত্ত্যক্তকারীরা জিতে যায়।

এক সময় আমার নানিও মায়ের সঙ্গে তাল মেলালেন। বললেন, ‘তুমি চিৎকার করেছ? তুমি কি হেসেছিলে? এ জন্যই তোমাকে তারা হয়রানি করার সুযোগ পেয়েছে। ’

আমি মনে করার চেষ্টা করলাম, আমি কি হেসেছিলাম? মনে হয় একবার হাসি পেয়েছিল। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি যৌন হয়রানির শিকার হয়েছি আমার মজাই লাগছিল।

আমার নানি বলেই চললেন, ‘তুমি এত ছোট জামা পড়েছ কেন? জামার হাতা এত ছোট কেন?’

আমি বুঝতেই পারলাম না—পুরো বিষয়টি কেন আমার বিপক্ষে গেল। জীবনে প্রথম একা বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। কয়েকটি ছেলে আমাকে উত্ত্যক্ত করেছে। এত দুঃখ পেয়েছি। অথচ আপনজনেরা আমাকেই দোষারোপ করছে। এটাই আমার জীবনের প্রথম যৌন হয়রানির ঘটনা। তবে এটাই শেষ ছিল না। এর পরে আরও অনেক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি।

এরপর আমার মা আমাকে বুঝিয়ে দিলেন বাইরে বের হলে কোন বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে,

১. এ রকম হয়েই থাকে, এটা খুব স্বাভাবিক
২. কোনোভাবেই হাসবে না।
৩. দ্রুত হেঁটে যাবে, দাঁড়াবে না।
৪. বড় লম্বা জামা পরতে হবে
৫. এমন কোনো আচরণ করা যাবে না যাতে কোনো রকম মনোযোগ আকর্ষিত হয় তোমার প্রতি।

জীবনে এ নিয়মগুলো আমি পালন করে এসেছি। অনেক সময় কাজে এসেছে অনেক সময় লাগেনি। মিসরে যৌন হয়রানি আমার এবং আমার বন্ধুদের জীবনের একটি অংশ ছিল। নোংরা কথা, আপত্তিকর স্পর্শ, গায়ে হাত দেওয়া, এমনকি জামা টানাটানির মতো ঘটনাগুলো আমাদের জীবনে হর হামেশাই ঘটেছে। এগুলো কিন্তু রাস্তার সাধারণ ছেলেরাই করত। দোকানদার, দারোয়ান, শিক্ষকেরা, সহকর্মী, এমনকি আত্মীয়েরা। তবে কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি মুখ খুলব, প্রকাশ করব এই অন্যায়ের কথা। অন্য সব মিসরীয় নারীদের মত আমরা ভারসাম্য করে চলছিলাম।

২০১৩ সালে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মিসরের ৯৯ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে যে কায়রো হল মেয়েদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক মেগাসিটি। তবে ১১ বছরের বয়সের ওই সময়ের চেয়ে এখন দিন অনেক পাল্টেছে। তরুণেরা এখন অনেক বেশি মুখর। যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে প্রচারণা চলছে এবং আইন প্রয়োগকারীরা এটিকে গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছেন। তবে হয়রানি কিন্তু এখনো বন্ধ হয়নি।

আমি এখন মিশরে থাকি না। কিন্তু যখন সেখানে যায় আমি অনেক দুশ্চিন্তা করতে থাকি। আমি এখনো সেই নিয়মের অদৃশ্য বর্মের মধ্যে আছি। এখানে এসে বাইরে বের হলে কাউকে সঙ্গে নিয়ে বের হই।

আমার আট বছরের ভাগনিকে দেখলে আমার নিজের কথা মনে হয়। আমি জানি তাকেও অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হবে। আমি তখন হয়তো তাকে মায়ের সেই নিয়মগুলোই বলব।

কিন্তু আমি মন থেকে কি তা বলতে চাই? আমার বলতে ইচ্ছে করে, ‘তুমি সুন্দর করে থাকবে, হাসবে, মজা করবে, নিজের জীবনকে উপভোগ করবে। আর কোনো জঘন্য মানুষ তোমাকে হয়রানি করলে, চিৎকার করবে, নিজেকে রক্ষা করবে। আর সব সময় মনে রাখবে এটা তোমার কোনো ভুল নয়। ''

হলিউডের খ্যাতিমান প্রযোজক হার্ভে উইনস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগের প্রেক্ষিতেই এই মি টু ক্যাম্পেইন।  আর এতে অসংখ্য অভিনেত্রী-মডেল যৌন হয়রানির অভিযোগ তুলেছেন হার্ভের বিরুদ্ধে। কখন কীভাবে তারা এর শিকার হয়েছেন তা জানিয়েছেন। হলিউডের কোন কোন অভিনেত্রী আবার টানা পাঁচ-সাত বছর ধরে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন প্রযোজক হার্ভে উইনস্টেইনের বিরুদ্ধে। তবে এই ক্যাম্পেইন শুধু হার্ভেতেই আটকে থাকেনি। যৌন হয়রানির শিকার সারা বিশ্বের নারী-পুরুষ তাদের না বলা কথাগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরছেন। এতে উন্মোচিত হচ্ছে অনেক ভদ্রবেশী সামাজিক কীটের মুখোশ।


বিবিসি অনলাইন অবলম্বনে

সম্পর্কিত খবর