মুড়মুড়ে শব্দে মুখরিত মুড়িপল্লী বারতোপা

মুড়মুড়ে শব্দে মুখরিত মুড়িপল্লী বারতোপা

শেখ সফিউদ্দিন জিন্নাহ্ • নিজস্ব প্রতিবেদক

বছর ঘুরে রমজান মাস আসলেই ব্যস্ততা বেড়ে যায় গ্রামের বধুদের। বাঙালিদের ইফতারির প্রধান অনুষঙ্গ মুড়ি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পরে তারা। যান্ত্রিক সভ্যতার এ যুগে হাতের ছোঁয়া ছাড়াও অধিকাংশ মুড়ি তৈরি হয়ে থাকলেও এখনও কদর রয়েছে হাতে ভাজা মুড়ির।  

ক্রেতাদের পছন্দের প্রতি সম্মান জানিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতা সত্বেও বছরের পর বছর ধরে এখনও টিকে রয়েছে গাজীপুরের শ্রীপুরের বারতোপা গ্রামের হাতে ভাঁজা মুড়ি  শিল্প।

আজ দুপুরে বারতোপায় ঢুকতেই দেখা মিললো গ্রামের মানুষদের ব্যস্ততা। কেউ লাকড়ি কুড়াচ্ছেন, কেউ মুড়ির চাল শুকাচ্ছেন, কেউবা মাটির খোলায় চালে উত্তাপ দিচ্ছেন। গরম বালুর পরশে তা মুড়মুড় করে ফুটে তৈরি হচ্ছে সুস্বাদু মুড়ি। প্রতিটি বাড়িতে মুড়ি তৈরির ব্যস্ততা বলে দিচ্ছে এ যেন মুড়িরই গ্রাম।

মুড়ি ফোটার শব্দের সাথে যেন জীবনের ছন্দ জড়িয়ে আছে তাদের।

news24bd.tv

সারা বছর এই গ্রামের নানাজন নানা ধরনের কাজ করলেও রমজান আসার আগেই নারী-পুরুষরা মুড়ি তৈরির কাজে লেগে যান। ক্রেতাদের বিষমুক্ত মুড়ি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে জীবিন ও জীবিকার তাগিদে তারা এ পেশায় জড়িত হন। নারীরা চাল শুকানো থেকে ভাজার কাছ করে থাকেন। আর পুরুষরা সেসব বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে দেন। সনাতন প্রক্রিয়ায় হাতে ভাজা মুড়ি যেন তাদের জীবনেরও একটা অনুষঙ্গ।  

হাতে ভাজা মুড়ির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এতে কোন ধরনের রাসায়নিক উপাদান প্রয়োগ করা হয়না। । শুধু চাউলে সামান্য লবণ পানি মিশিয়ে তা ভেজে গরম বালুতে ছেড়ে দেয়া হয়। আর এতেই মুহূর্তের মধ্যে তৈরি হয়ে যায় সাদামুড়ি।

বারতোপা গ্রামের গৃহবধু জমিলা খাতুন নিউজ টোয়েন্টিফোরকে জানান, তারা বংশানুক্রমিকভাবে মুড়ির তৈরির মাধ্যমে জীবিকা চালিয়ে আসছেন। কিন্তু যান্ত্রিক সভ্যতার এ যুগে তাদের সনাতনী পদ্ধতি এখন প্রায় অচল। তবে তাদের তৈরি মুড়িতে কোন বিষাক্ত পদার্থ না থাকায় সচেতন লোকদের মধ্যে বিক্রি করা যায়।  

news24bd.tv

বাজারে যেখানে সাধারণ মুড়ি ৬০ টাকায় পাওয়া যায়, সেখানে তাদের হাতে তৈরি মুড়ি বিক্রি হয় ১শ টাকায়।

জমিলার প্রতিবেশী আব্দুস সাত্তারের ভাষ্য, নানা কারণে এই গ্রামের অনেকেই এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন। ‘বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে আসায় এখন আর আমরা টিকতে পারছি না। তবে পেশার মায়ায় এখনও কোনভাবে টিকে রয়েছি’ বলে জানান সাত্তার।

গ্রামের আরেক গৃহবধু কমলা আক্তার জানান, এখানেও রয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীদের আনাগোনা। গ্রামের অনেকেই হতদরিদ্র, বিধায় যাদের পুঁজি নেই তারা অনেকেই মহাজনদের সাথে মুড়ি ভাজার চুক্তি করেন। মহাজনরা শুধু ধানের যোগান দিয়ে থাকেন। বাকি সব উপকরণ মুড়ি তৈরির কারিগরদের দিতে হয়। ৬ মন ধানের মুড়ি ভেজে দিলে কারিগরদের দেয়া হয় ৩ হাজার টাকা।

সত্তোরোর্ধ্ব আয়েশা আক্তারের অভিমত, বাজারে বড় ও ধবধবে মুড়ির চাহিদা বেশি। তাই অনেক কারিগর লবণের বদলে ইউরিয়া ও হাইড্রোজ মিশিয়ে মুড়ি ভেজে থাকেন। ফলে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে হাতে ভাজা মুড়ির স্বাদ। তবে তাদের তৈরি মুড়িতে কোন বিষাক্ত রাসায়নিক প্রয়োগ করা হয় না, যা প্রয়োগ করা হয় কারখানাগুলোতে।  

একই এলাকার সোহরাব হোসেন জানান, তিনি বিগত ২৪ বছর ধরে রমজান উপলক্ষে মুড়ি তৈরি করছেন। কিন্তু এখন আর এতে তেমন লাভ হয়না।  তবুও ক্রেতাদের অনুরোধে তিনি গত সাতদিন ধরে স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে মুড়ি তৈরি করছেন।

শ্রীপুর মিজানুর রহমান মহিলা কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান ইকবালের মতে,বর্তমান বাজারে যে ধবধবে সাদা মুড়ি পাওয়া যায় তার অধিকাংশতেই রাসায়নিকের মিশ্রণ রয়েছে, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। তবে সনাতন পদ্ধতিতে হাতে ভাজা মুড়িতে বিষের প্রয়োগ না থাকায় সচেতন মানুষের মধ্যে এর ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

news24bd.tv

বারতোপা বাজারের মুড়ির আড়ৎদার মহর আলীর জানান, বছর পাচেঁক আগেও এই গ্রামের শতাধিক পরিবারের অন্যতম জীবিকা ছিল মুড়িকে কেন্দ্র করে। সময়ের বিবর্তনে এখন তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। তিনি বিভিন্নভাবে মুড়ির কারিগরদের সহায়তা করে থাকেন। আগে সারাবছর এই গ্রামে মুড়ি তৈরি হলেও এখন শুধু রমজান মাসকে ঘিরেই তা তৈরি হয়।  

তিনি বলেন, হাতে ভাজা মুড়িতে প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়, বিধায় এসব মুড়ির চাহিদা বেশি। তবে হাতে মুড়ি তৈরিতে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় প্রতি কেজি ১শ টাকা দরে বিক্রি করতে হয়। আর তিনি গ্রাম ঘুরে সংগৃহীত মুড়ি রাজধানী ঢাকায় প্রেরণ করেন।

জিন্নাহ্/অরিন/নিউজ টোয়েন্টিফোর

সম্পর্কিত খবর