‘জাতিগত নিধনের শিকার রোহিঙ্গাদের রক্ষায় বিশ্ব ব্যর্থ’

‘জাতিগত নিধনের শিকার রোহিঙ্গাদের রক্ষায় বিশ্ব ব্যর্থ’

নিউজ টোয়েন্টিফোর ডেস্ক

কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা জানিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত ওই নিবন্ধের বাংলা অনুবাদ পাঠকদের কাছে তুলে ধরা হলো:

==========

ছোট ছোট শিশুদের হত্যা করা হয়েছে তাদের বাবা-মায়ের সামনে। মেয়ে শিশু ও নারীদের দল বেঁধে ধর্ষণ করা হয়েছে। পরিবারের সদস্যদের অত্যাচারের পর হত্যা করা হয়েছে।

গ্রামের পর গ্রাম, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড এবং সহিংসতার মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের কাছ থেকে গত সপ্তাহে যেসব হাড় কাঁপানো ঘটনা আমি শুনেছি, তার জন্য কোনোভাবেই প্রস্তুত থাকা সম্ভব ছিল না।

সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর একজন সদস্য তার বড় ছেলেকে নিজের সামনে গুলি করে হত্যা করার বর্ণনা দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ওই লোকের মাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় এবং তার বাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়।

তিনি মসজিদে আশ্রয় নিলেও মিয়ানমার সেনারা সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে এবং কুরআন পুড়িয়ে দেয়।

সত্যিকার অর্থেই জাতিগত নিধনের শিকার এসব মানুষ এমন যন্ত্রণা ভোগ করছে যা একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মধ্যে শুধুমাত্র বেদনা ও রাগই উসকে দিতে পারে। তাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা বোঝার অতীত, তবু এটাই ১০ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর জন্য বাস্তবতা।

রোহিঙ্গারা এমনি নির্যাতনের শিকার যে নিজ দেশ মিয়ানমারে নাগরিকত্ব থেকে শুরু করে নিতান্ত মৌলিক মানবাধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভেতরে ত্রাস ঢুকিয়ে দিতে গত বছর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী পদ্ধতিগতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। তাদের লক্ষ্য ছিল রোহিঙ্গাদের ভয়াবহতার দিকে ঠেলে দেওয়া; ‘মৃত্যুর ভয় নিয়ে অবস্থান করো নয়তো বেঁচে থাকার জন্য সবকিছু ছেড়ে চলে যাও’।

news24bd.tv

নিরাপত্তার সন্ধানে দুর্বিষহ যাত্রা শেষে এসব উদ্বাস্তুরা বাংলাদেশের কক্সবাজারে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। এটা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সঙ্কট। সীমিত সম্পদ নিয়ে বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। তারপরও বাংলাদেশের জনগণ ও সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য তাদের সীমান্ত ও হৃদয় খুলে দিয়েছে, যেখানে বৃহত্তর ও সম্পদশালী দেশগুলো বাইরের মানুষের মুখের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে।

বাংলাদেশের মানুষ যে মমত্ববোধ ও উদারতা দেখিয়ে দিয়েছে, তা মানবতার সর্বোচ্চ রূপ এবং বাংলাদেশিরা হাজারো মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে। কিন্তু এই সঙ্কটের অবশ্যই বৈশ্বিক সমাধান করতে হবে।

প্রাণ হাতে নিয়ে পালানো মানুষের আশ্রয় দিতে বাংলাদেশের মতো সামনের সারির দেশগুলো যাতে একা হয়ে না যায়, তার জন্য জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো শরণার্থী বিষয়ে একটি বৈশ্বিক চুক্তি চূড়ান্ত করছে। তবে এখনকার জন্য জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবিক সাহায্য সংস্থাগুলো পরিস্থিতির উন্নয়নে শরণার্থী ও আশ্রয়দাতা দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করছে।

কিন্তু দুর্যোগ এড়াতে আরও সম্পদ জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন। সেই সঙ্গে শরণার্থী সঙ্কটে বৈশ্বিকভাবে দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার যে নীতি, তাকেও আরও গুরুত্ব দিতে হবে।

১০০ কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তার আহ্বানের বিপরীতে মাত্র ২৬% তহবিল জোগাড় হয়েছে। এই ঘাটতির অর্থ শরণার্থী শিবিরে অপুষ্টি বিদ্যমান। এর অর্থ হলো পানি ও স্যানিটশনের আদর্শ অবস্থা থেকে অনেক দূরে। এর অর্থ আমরা শরণার্থী শিশুদের মৌলিক শিক্ষা দিতে পারছি না। শুধু তাই নয়, বর্ষাকালের তাৎক্ষণিক ঝুঁকি মোকাবেলায় পদক্ষেপগুলোও অপর্যাপ্ত।

আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের তাড়াহুড়ো করে তৈরি বস্তিগুলো এখন ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিকল্প জায়গা খুঁজে আরও জোরালো আশ্রয়স্থল নির্মাণ অত্যন্ত জরুরি।

এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অনেক কিছুই করা হয়েছে। তবে সঙ্কটের সামগ্রিক পরিসরের কারণে মারাত্মক ঝুঁকি রয়ে গেছে।

বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের সঙ্গে আমি বাংলাদেশ সফর করেছি। রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাদের আশ্রয়দাতাদের সহায়তায় ব্যাংক থেকে ৪৮০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার ঘোষণাকে স্বাগত জানাই। তারপরও আন্তর্জাতিক মহল থেকে অনেক অনেক সহায়তা দরকার। শুধুমাত্র সংহতি জানালেই হবে না, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন বাস্তব সহায়তা।

মিয়ানমারে এতো নির্যাতন সহ্য করার পরও কক্সবাজারে আমার দেখা রোহিঙ্গারা আশা ছেড়ে দেয়নি। আমরা চাই মিয়ানমারে আমাদের নিরাপত্তা ও নাগরিকত্ব দেওয়া হোক। আমাদের বোন, কন্যা ও মায়েদের যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তার বিচার আমরা চাই, ধর্ষণের ফলে জন্ম নেওয়া নিজ শিশুকে বুকে নিয়ে থাকা এক মাকে দেখিয়ে তিনি বললেন বিপর্যস্ত কিন্তু দৃঢ়চেতা এক নারী।

রাতারাতি এই সমস্যার সমাধান হবে না। একইভাবে এই পরিস্থিতি অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতে দেওয়াও যায় না।

মিয়ানমারকে অবশ্যই পূর্ণ অধিকার এবং নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের প্রতিশ্রুতিসহ শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার জন্য উপযোগী পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। এর জন্য দরকার ব্যাপক বিনিয়োগ- এটা শুধু মিয়ানমারের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলের সকল জনগোষ্ঠীর জন্য পুনঃনির্মাণ ও উন্নয়নের ক্ষেত্রেই নয়, পুনর্মিলন ও মানবাধিকারের জন্য শ্রদ্ধাবোধ ফেরানোর জন্যও দরকার।

রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার গোড়ার কারণগুলো খুঁজে বের করে সামগ্রিক সমাধান না করা হলে দুর্দশা ও ঘৃণার সংঘাত চলবেই। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিস্মৃত ভোক্তভোগীতে পরিণত হতে পারে না। সহায়তার জন্য তাদের জোরালো আবেদনে আমাদের অবশ্যই সাড়া দিয়ে কাজে নামতে হবে।

==========

অরিন/নিউজ টোয়েন্টিফোর

সম্পর্কিত খবর