এক আজ বহুদিন পরে মনে হচ্ছে,যতই অসংলগ্ন হোক, আমি আমার জীবনের স্মৃতি নিয়ে কিছু লিখি। আমি ভাগ্যবান, একটা শতাব্দীর দুই প্রান্ত দেখেছি। জীবনের হুহু করে পালটে যেতে থাকা দেখেছি। আমি এনালগ এবং ডিজিটাল দুই জীবন দেখেছি। কবে কি বোধ থেকে বারবার উচ্চারণ করতাম এনালগ শতাব্দীর দিনরাতগুলো এতো সুন্দরতম দীর্ঘ ছিলো!।
মনে হল,আমি বহুদিন আগে প্রতিটা মুহূর্ত যেন ছুঁতে পারতাম! প্রযুক্তির এ শতাব্দীর একটা মাস যেন একটা একটা দিনের মতো হয়ে গেছে।
ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টালেই ধাক্কা খাই,,এতো জলদি মাস চলে গেল!বছর গেলো!এখন ফের একটা মাস যেন একটা দিনের মতো হয়ে গেছে। আগে অপেক্ষা করতাম,রাস্তায় হেঁটে হেঁটে কখন গলির মাথায় ডাকপিয়নের দেখা পাব। পিওনের টেকো মাথা ছিল,সদ্য প্রেমে পড়া প্রেমিকের মতো। কারণ তার হাতে হয় আমার প্রেমিকের নয় পত্রবন্ধুদের চিঠি আসবে। আমি আর রুবী(পারভীন সুলতানা) একসাথে রোমাঞ্চিত হতাম।
স্কুল বয়সেই আমাদের সারাদেশের লেখকদের সাথে পত্র যোগাযোগ ছিল। (এ নিয়ে আরেকদিন লিখব। ) আমার ছোটবোন ঝর্না আমাদের সেইসব দিনের অপরিহার্য অংশ ছিল। । আসলে তখন মোবাইলহীন,ফেসবুকহীন জীবন অনেক সুন্দর আর গভীর ছিলো। এসব ছাড়া তখনকার যোগাযোগে কোন অজুহাত ছিল না। যখন যেখানে যাওয়ার কথা ঠিক একসাথে সময়মত জড়ো হয়ে যেতাম। প্রতি বছর পিকনিকে যাওয়ার মতো আনন্দ আর কিছুতেই ছিল না।
বইমেলা ছিলো স্নিগ্ধ, মনে হত,এই মেলা আমার জন্যই অপেক্ষা করছে! মেলায় হইচই, মিডিয়া ছিল না। মোড়ক উন্মোচন এসব ছিল না। আর ফোনহীন দেখাহীন হওয়ায় মেলায় দেখা হলে পাগলের মতো একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরতাম। সিনিয়র লেখকদের সাথে দেখা হলে ছবি তোলার উন্মাদনা ছিল না। একটা স্মৃতি বলি,একবার ইলিয়াস ভাইয়ের (আখতারুজ্জামান ইলিয়াস) সাথে ঘাসে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। একটা স্টলের সামনে প্রচুর ভিড় ছিল। বাদাম খেতে খেতে ইলিয়াস ভাই মজা করে বললেন, তোমার স্টলের সামনে এমন ভিড়ের স্বপ্ন দেখছ নাতো? তখন আমরা জানতাম, মানিক,জীবনানন্দ, জীবদ্দশায় এঁদের তেমন পাঠক ছিল না। আমি বলেছিলাম,ভিড় করে আমার বই কিনবে,আপনি জানেন,এইদেশে এমন লেখক হতেই পারব না আমি। আসলেও হইনি। যতটা পরিচিতি আছে আমার তারচেয়ে অনেক অনেক কম বই বিক্রি হয়। যা হোক,তখন আমরা নিজেরা ঘুরে ঘুরে সবার আগে নিজের বন্ধুর বইটা আগে কিনতাম।
আমরা পিকনিকে,বইমেলায় কীভাবে মোবাইল, ফেসবুক এমনকী টিএনটি ফোন ছাড়াও যোগাযোগ করে ঠিক সময়মত একসাথে জড়ো হয়ে যেতাম,এখন ভাবলে অবাক লাগে। এই বিভ্রমময় দিনগুলির হিসাব মেলাতে বেক্কল লাগে নিজেকে,, তবে কি পাহাড়ে উঠছি ভেবে পাতালে গড়াচ্ছি? যত যোগাযোগ সহজ হয়েছে,ততো অজুহাত বাড়ছে?
মনে পড়ছে,প্রথম লেখার স্মৃতি। শৈশব থেকে আমি প্রকৃতিপাগল। বাল্যকালে সরষেবনে পড়ে থাকতাম,ঘ্রাণে আকুল হয়ে। যুদ্ধের পরে রূপকথার গ্রাম ছেড়ে ইঁটপাথরের মফস্বলের বাড়িতে দম আটকে আসত। ময়মনসিংহ শহরে এসে সানকিপাড়া প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস টু তে ভর্তি হলাম। দীর্ঘ রেললাইন পেরিয়ে তারপর অনেকগুলো দোকান,যেখানে বাংলা সিনেমার গান বাজত।
ওই বয়সে রেললাইন টপকে ওই গানে আটকে যেতাম। আশ্চর্য!, প্রায়ই তখন যেন একটা গান শুনতাম,গীতিময় সেইদিন চিরদিন বুঝি আর রলোনা, ক্লাস টু এর নাসরীন ধীরে ধীরে ঘোরগ্রস্তের মতো সামনে পা শুনতো দোকানের পরে দোকানে বাজতে থাকা সেইসব গানের সুরে আচ্ছন্ন হয়ে হয়ে। প্রতিদিন স্কুলে যেতে দেরি হয়ে যেত।
প্রতিদিন ক্লাসে যেতে দেরি হয়ে যেত আমার। বাবা মা সেখান থেকে আমাকে তুলে আনত। ক্লাস ফোরে প্রথম ছড়া লিখি। স্কুলের বসন্ত উৎসবে। তখন ছন্দের সাথে মন্দ এসব বুঝে গেছি। তাল ঠিক করতাম,গায়ে থাপ্পর দিয়ে দিয়ে। জীবনের প্রথম লিখি,বসন্ত এলো ও বসন্ত এলো, ও ময়ূর তুমি পাখা মেলো।
মুক্তিযুদ্ধের হাহাকার পেরিয়ে তখন যেন আমার হঠাৎ বড় হয়ে ওঠা। ময়মনসিংহের প্রচুর স্মৃতি আর বাস্তবতা পেরিয়ে ঢাকায় এসে ভর্তি হয়েছিলাম হলিক্রসের শাখা স্কুল বটমলী হোমসে। ছোট ফুপুর মেয়ে শীলা,শবনম জাহান যার নাম,তার নামের সাথে ফুপু আমার নাম নাসরীনের সাথে জাহান যুক্ত করলেন। সেই শীলা এখনো আমার প্রাণের সাথে জড়িয়ে আছে।
আমি কোনকিছু ধারাবাহিকভাবে স্মরণ করতে পারি না। কিন্তু বিছানায় গেলে ধেয়ে আসে স্মৃতি! তখন অনেক সীমাহীন তেপান্তরে বেলুন উড়ানো দেখতে যাই,অথবা উড়াই,নিজের প্রশ্ন করি, মন,তুমি যতই মনে কিশোরী যুবতী হয়ে থাকো, তোমার দেহ বার্ধক্য ছুঁয়েছে, হা হা। এখন তো মনে হয় দিন কে প্লাস্টিক বানিয়ে বারবার কাটতে গিয়ে দাঁত ভেঙে যায়, জিহ্বা অসার হয়, আমি কী নিজের অজান্তে দিনে প্লাস্টিক বানিয়ে মাস চিবুই? আহা!নিজেকে ঝাঁকড়া রোদে যদি তাপিয়ে আনতে পারতাম?
নানার বাড়ি আমার অস্তিত্বের শেকড় গাঁথা আছে। শুরুর জীবনে বেশিরভাগ সময় নানার বাড়ি থাকতাম,তখন দেখতাম,নানী সিলিং থেকে এনে পিতলের বড় বোয়ামে কী যেন যেন আনতেন, যা ঝনঝন করত। যখন কেউ থাকত না,নানী গোপনে সেই বোয়ামের মুখ খুলে দেখত।
একদিন একটা চকচকে আধুলি বিছানায় পড়ে গেলে আমি বিহবল চোখে দেখি,যেন আসমান থেকে যেন তারা খসে পড়েছে!,নানী দ্রুত তা তুলে বোয়ামে ভরে বলেন যা,এইসব ছোটদের জিনিস না। তখন আমি ঠাকুরমার ঝুলি পড়ে ফেলেছি। ফলে চোখের সামনে এসে পড়া সেই আকাশের তারা সারাদিন সারারাত চোখ থেকে সরে না। যেন রূপকথার রাজ্য থেকে কোন চৌকস পাথর ছিটকে পড়েছে! কিছুতেই যেন সেই রুপোলী তারা জীবন থেকে খসে পড়ে না। একসময় নিজেকে ক্রমশ বিন্যস্ত করে নিই।
আমরা অবশ্য শৈশবে নানার বাড়ি থাকতে কিচ্ছুর অভাব অনুভব করিনি। কিন্তু ময়মনসিংহ শহরে থাকা আমাদের এ্যাডভোকেট বড়মামার মেয়ে হল। পর পর দুই ছেলে। তারা একবার গ্রামে বেড়াতে এল। তখন আমরা ছয় ভাইবোন শহর গ্রাম করলেও দড়িনগুয়া গ্রামটাকেই নিজের বলে আঁকড়ে ধরেছিলাম। শহরে যতদিন থাকতাম দম আটকে আসত। ছোট খালা রেনুর বিয়ে হলেও সে নানা বাড়ি থাকত। তুখোড় ভার্সিটি ছাত্র খালুর পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন নানা। যখন খালু বাড়িতে আসত বাড়িতে আধুনিকতার জোয়ার বইতো যেন। খালুর তত্বাবধানে মামা খালারা, মাঝে মধ্যে আমরাও কার্ড নিয়ে নাইন্টি ফাইভ খেলতাম। মামারা,বিশেষ করে মেঝো মামা এখলাছ ততকালীন আওয়ামীলীগের সাথে জড়িত ছিলেন। বাড়িতে তখন একটা উদার হাওয়া বইত। খালা দারুণ অভিমানী আর জেদি ছিল। খেলায় হারলে বা কেউ চোট্টামি করছে টের পেলে সে সব কার্ড ছিড়েখুঁড়ে খালুর মুখে ছুড়ে মারত। খালু তখন খালার পেছন পেছন ঘুরে গান গাইতো,নাইন্টি ফাইভ আর খেলব না,স্ত্রী বলে স্বামী না,এমন তো আর দেখি না। সেই গান নানা বয়সের নানা প্রান্তে আমার কানে গুঞ্জরিত হয়েছে। হয়। জীবন বাস্তবতায় আমরা কোথায় কীভাবে ছিটকে গেলাম! খালা খালুকে কিল দিয়ে ছুটত,খালুও পেছন পেছন, এ নিয়ে আশে পাশের গ্রামের দরিদ্র নারী পুরুষ মজাই পেত। পরে, কুমিল্লার শ্রীকাইল কলেজের অধ্যাপক খালু দবলিগে যাওয়া শুরু করলেন। খালা এই জীবনে সহ্য করতে পারতেন না
তাদের সন্তানরা জাঁহাবাজ স্টুডেন্ট, কিন্তু এখন তাদের শিক্ষিত বড় মেয়ের বাইরের পুরুষ মানুষের কন্ঠ শোনাও পাপ। সে আপান মামাতো চাচাতো যেই হোক। খালা অবশ্য তেমনই ছিলেন। খালু ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। আমাদের সাথে খালুর ব্যবহার কখনও বদলায়নি। খালুর সামনে যেতে মাথায় ওড়না টানতে হয়নি কোনদিন। কিন্তু খালুর বড় ছেলের বিয়েতে গিয়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বড় ছেলে সারা জীবন ক্লাসে যে ফার্স্ট ছিল ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটি থেকে দারুণ রেজাল্ট করে পাশ করেছে। দারুণ চাকরি করে। দেখি,তার পরনে সৌদি আরবীয় পোশাক। খালুকে পর্যন্ত সে তার বউয়ের মুখ দেখতে দেয়নি,খালু পরপুরুষ বলে। খালার সেকী কান্না,সেই যে জেদ ধরলেন,বউয়ের মুখ তিনিও দেখবেন না,তার মীমাংসা কোথায় গিয়ে হয়েছিল,এ আমি আর দেখতে যাইনি।
অথচ জন্মের পরে এই ছেলেটার বাংলা ডাক নাম আমি আমার শিশুদের জন্য লেখা গল্পের চরিত্র থেকে রেখেছিলাম। ওর জন্মের পরে নানা বাড়িতে বেশ কয়েক বছর সে আমার আর পিঠাপিঠি বোন ঝর্ণার আত্মার সাথে জুড়ে ছিলো। মনে পড়ে খালা যখন সন্তানসহ স্থায়ীভাবে শ্বশুরবাড়ি চলে যায়,আমি আর ঝর্না অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বাসের পেছন ধরে অনেকদূর গিয়েছিলাম। খালু সন্তানদের ধর্ম শেখাতে চেয়েছিলেন, তারা ধর্মান্ধ হয়ে রীতিমতো আত্মীয়চ্যুত হয়ে যাবে,এ তিনি কল্পনাও করেননি।
যা হোক,একদিন নানার বাড়ির রূপকথার প্রথম কাগজ ছিঁড়ে যায়, এরমধ্যে একবার সপরিবারে বড় মামারা বাড়ি আসেন। আমরা হট্টগোল করতে করতে দেখি,মামাদের দুই পুচকে ছেলে সেই আকাশের তারা নিয়ে লোফালুফি খেলছে। আমি এগিয়ে যেতেই পেছনে লুকিয়ে জানায়,এইসব রুপার আধুলি। দাদী তাদেরকে যত্ন করে রাখতে বলেছে। আহা! রুপার আধুলি!সেই জীবনে একটা আধুলি যদি নানী আমাকে দিত,আমি সারাজীবন যক্ষের ধনের মতো আটকে রাখতাম না? পুত্র আর কন্যা সন্তানদের ভেদ এত তীব্রভাবে আমার শৈশবের বুক চিড়ে দিত? এ আমার আত্মজীবন নয়,তা লেখা সম্ভবও নয় আমার পক্ষে, মাঝে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে সুস্থ হওয়ার পরে বহু স্মৃতির আলো নিভে গেছে। বহু স্মৃতির ধারাবাহিকতা বলে কিছু নেই বললেই চলে। আমি কেবল একটা সময় এবং কিছু অনুভব ধরে রাখার জন্য যখন যা মনে পড়েছে খামচি দিয়ে এনে একটার পরে একটা জড়ো করছি।
আমি পৃথিবীর কত জায়গায় গেছি,লেখার জন্য কিচ্ছু দেখিনি বলে, দেখার জন্য দেখেছি প্রাণপণ ভরে। আমি হাঁ করে একেক দেশের একেক মানুষের সঞ্চালন দেখেছি। কাগজ কলম নিইনি, যেখানে ভিডিওর সুযোগ, করিনি। আমি দলবাজির রাজনীতিও করিনি। কেবল স্বাধীনতার পক্ষের মানুষ ছিলাম, আছি। রাজাকারের প্রতি ঘৃণার অপরিসীম। হিপোক্রেসি কাকে বলে আমি জানি না । কোনদিন কোন জায়গায় গেছি নোট করে রাখিনি। কিন্তু মনে হচ্ছে,জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গার স্মৃতি নামসহ যদি লিখে রাখতে পারতাম?
আত্মজীবনী বলে কিছু আসলে হয় না,মানুষ তার সিক্রেট জীবন কেন পাবলিক করবে? একজন মানুষের সাথে জড়িয়ে থাকে আরেকজন মানুষের প্রাইভেসি,কেন কেউ তা নষ্ট করবে?একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছি,আত্মজীবনী নামে যা লেখা হয়, কোন লেখক কার সাথে, কতজনের সাথে শারীরিক সম্পর্ক করলো,তা না লিখলে যেন লেখকের সাহসই প্রকাশ হয়না!
কয়েক মিনিট করে যত বিছানার সম্পর্ক নিয়ে লেখা যায়,ততো সাহসের প্রকাশ। এই যেন আত্মজীবনীর উপজীব্য। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ কাউকে কেউ বাঁচালো, কীনা,সেটা সাহস নয়। কেউ সংগ্রাম করে কিছু করল কীনা,তাও নয়, ফলে আত্মজীবনী অন্তত আমাদের জীবন বাস্তবতায় লেখা সম্ভব নয়,তা হয়ও না। কেন নিজের জীবনের উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা আর স্মৃতির মিশেল একসাথে জড়ো করলে তার নাম আত্মজীবনী দিতে হবে? খামোকাই পাঠকের প্রত্যাশা পূরণে ব্যার্থ হওয়া?
সেই রুপার আধুলি একটা সময় নানা জায়গায় আমার অতৃপ্তির বিষয় হয়ে উঠেছে। মনে পড়ছে একটা অনুষ্ঠানে রাস্ট্রিয় অতিথি হয়ে আসামে গিয়েছিলাম। সেখানে কয়েকটা মঞ্চে প্রোগ্রামে অংশ নিই। একটা প্রোগ্রাম ছিলো আকাশের তলায়। সাজানো মঞ্চে আমি বসে আছি টানা কয়েক ঘন্টার প্রশ্নোত্তর পর্ব চলছে,এর আগে আয়োজক অধ্যাপক এলেন হোটেলে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে আমি যখন বলেই যাচ্ছি পরকীয়ার ব্যাপারে,ধরা যাক,একজন স্বামীর সাথে স্ত্রী এক বিছানায় শুয়েও অন্য একজনের কথা ভেবে দহনে পুড়ে ছাই হচ্ছে, অথবা একজন স্ত্রীর পাশে যে স্বামী, যে সারাজীবনের জন্য তার স্ত্রীর মানসিক শারিরীক দায়িত্ব পালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ,নিজের অজান্তে অন্য একটা বাতাস এসে তাকে যখন নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে যা তাদের কারো হাতে নেই। ,স্ত্রী প্রাণপণে নিজের দহন স্বামীকে লুকাচ্ছে,অন্যদিকে স্বামীও লুকাচ্ছে স্ত্রীকে। কারণ এই একান্ত যাতনার বিষয়টা পাবলিক হলেই ঘরে বাইরে দহনের গোষ্ঠী কিলিয়ে কী বদনাম!কী বদনাম! সব ভেঙেচুরে ছাড়খার!
অধ্যাপক হাঁ হয়ে ছিলেন। আশরাফ চুপচাপ হাসছিল। ভদ্রলোক বললেন, আপনি এতো অনায়াসে এর সাথে ওর বিছানা, ওর সাথে এর বিছানা কীভাবে বলেন? আমি বললাম, ধুর! লজ্জা পাচ্ছেন?এটা লজ্জা পাওয়ার কোন বিষয় নয়। ইহাই জীবন বাস্তবতা। উনি বললেন,প্লিজ কাল মঞ্চে এসব নিয়ে কিছু বলবেন না,এখানকার দর্শক অনেক রক্ষণশীল। পরদিন মঞ্চে বসে আমি অবাক! অনেক দর্শক। তার মধ্যে আমার বইয়ের পাঠকও ছিলো। তারা আমার শৈশব নিয়ে, লেখা শুরু নিয়ে, এবং কেউ কেউ আমার বই থেকে নানা প্রশ্ন করে যাচ্ছিল,আমি নিমগ্নের মতো উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম, এরমধ্যে আশরাফ সেই ভদ্রলোককে মিঠে জব্দ করতে প্রশ্ন করে, আপনি, পরকীয়া আর জায়গা ভিন্নভেদে স্বামী স্ত্রীর দহন নিয়ে গতকাল কিছু বলছিলেন, আজ সেই কথাগুলো এখানে সবার সামনে আবার বলবেন? আমি বিব্রত মুখের অধ্যাপক ভদ্রলোককে আশ্বাস দিয়ে ফের সেই কথাগুলো যাতে দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়,যে পরকীয়া কেবল প্রেমের মধ্য থেকে জন্ম নেয়,বিয়ে পরিবারকে বাঁচাতে যাকে একটা পর্যায়ে যতটা গোপনে সম্ভব কোন পুরুষ বা নারী প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়,তা কেবলই নষ্টামী নয়। এর মধ্যেও ব্যক্তি মানুষের প্রচন্ড বেদনা জড়িত থাকে ,আমি এসব নিয়ে যখন বলে যাচ্ছি,আমি লক্ষ করলাম,সময়ের পর সময় পেরিয়ে যাচ্ছে,তারা মাথা নেড়ে নেড়ে চুপ করে শুনেই যাচ্ছে শুনেই যাচ্ছে। কারও লজ্জা বা অস্বস্তি হতে পারে এমন কোন বিষয়ই আর রইল না। ধীরে ধীরে সবার কাছে দহনটা বড় হয়ে উঠল। ওদের শেষ প্রশ্ন ছিল,আপনি শুরুর জীবনের কোন জিনিসটা আপনি পাননি বলে আপনার শৈশব আমার জীবনকে তাড়িত করেছে?আমার চোখের সামনে ঝলসে ওঠে নক্ষত্রের মতো রুপোর আধুলি। যা আমি কোনদিন কোন লেখায় আনিনি। যা কোন সাক্ষাৎকারেও বলিনি। নিজের একান্ত গহীন এক অতৃপ্তি,যা আজ প্রকাশ করলাম। যা সেদিন আসামের প্রোগ্রামেও প্রকাশ করিনি। কিন্তু সেদিনের সেই প্রশ্ন আমার মনের কুয়োর একেবারে তলায় পড়ে থাকা আধুলিটি একটানে আমার চোখের সামনে নাচিয়েছিল,যা মামাতো ভাইরা স্বপ্নহীন চোখে মার্বেলের মতো ঘুরাচ্ছিল।
কথা ঘুরাই, আমার দাদার প্রচুর সম্পত্তি ছিল। আমার অন্যান্য চাচা ফুপুদের ধনাঢ্য জীবন দেখে তা সবাই আন্দাজ করতে পারত। বোহেমিয়ান, সুপুরুষ আব্বার বিপরীতে আম্মা দেখতে তেমন ভালো ছিলেন না।
আমাদের জীবনের গ্রাম থেকে আসা আমার দাপুটে, কোমল আম্মা যদি আমাদের সংসারের হাল না ধরতেন। সেই পিচ্চিবেলা থেকে পিরিয়ড কী,সন্তান কীভাবে পেটে আসে,খারাপ স্পর্শ ভালো স্পর্শ এসব না বোঝাতেন,সম্পত্তি আমরা কবেই জলের মধ্যে ভেসে যেতাম! ছুটিত, ঈদে আমরা কোনদিন আমরা আব্বাকে কাছে পাইনি। এদিকে ওদিকে ভ্রমণরত আব্বা সংসারের মানুষ ছিলেন না। কিন্তু এমন একটা শিশুর মতো মানুষ আমার আর ঝর্নার প্রিয় ছিল ঝর্না আজীবন ছিল,আমার প্রাণের একটা অংশ। যা এখনো আছে। এইসব কথা পরে বলব। কিন্তু আব্বা না থাকলে আমার লেখালেখি হত না। এটাও ঠিক। আমি বাংলাবাজার পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক থাকাকালীন ছফা ভাইয়ের বাসায় অনেক যাওয়া পড়ত। সেখানে ডাকসাইটে শামীম সিকদারও খুব আসতেন। একদিন যখন জলের দামে জমি বিক্রি করে প্রায় ভিখারি হওয়া আব্বার কথা, এবং সেই কারণে দুর্বিপাকে পড়ে একদিন একবেলা ভাতের ঘ্রাণ নিতে কেমন উন্মাদ হয়ে পড়েছিলাম, এসব গল্প করছি,ছফা ভাই বলেন,নাসরীন তুমি আসলেই একটা ভিতরবাউলা মানুষ, তুমি ক্যান সংসারের মধ্যে ঢুকছ? চলো এক কাম করি,তুমি একটা বস্তা নেও আমি একটা দোতরা নিই,চলো আমরা পথের মধ্যে নাইমা পড়ি,আমরা গান গায়া গায়া বাকি জীবন ভিক্ষা করুম । ছফা ভাই আরও বলতেন,ক্যান খালি অতীতরে সামনে টাইন্যা আইনা বর্তমানের সুখ নষ্ট করো? অতীতরে কাগজ মধ্যে ঢাইলা দিয়া সামনের দিকে তাকাও,,।
( চলবে)
নাসরীন জাহান : কথাসাহিত্যিক। কবিতাও লিখছেন কয়েকবছর থেকে। পুরস্কার পেয়েছেন ফিলিপ্স সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪) (উড়ুক্কু উপন্যাসের জন্য)। আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৫) (পাগলাটে এক গাছ বুড়ো গল্পের জন্য),বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। নাসরীন জাহান ১৯৬৪ সালে ৫ মার্চ বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাটে জন্মগ্রহণ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে নাসরীন জাহান কবি আশরাফ আহমেদের স্ত্রী। লেখালেখির সূত্রেই তার সাথে পরিচয় এবং সে থেকে প্রণয়। ১৯৮৩ সালে তারা বিয়ে করেন। তাদের এক মেয়ে। নাম অর্চি অতন্দ্রিলা। news24bd.tv/ডিডি