দুধ-বিড়ালের গল্প এবং রপ্তানি আয়ের হিসাব

এক শাশুড়ি তার বউমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাটির দুধ গেল কই বউমা’ ? বউমা উত্তরে বলল, ‘দুষ্ট বিড়ালটা খেয়ে ফেলেছে মা, আর বলবেন না, ও যা জ্বালায়’। বুড়ি শাশুড়ি তখন একটি দাঁড়িপাল্লা এনে বিড়ালের ওজন মেপে দেখলেন বিড়ালের ওজনের কোনো পরিবর্তন নেই। তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘বিড়াল যদি দুধ খাবে তো তার ওজন গেল কই, আর না খেয়ে থাকলে আমার দুধ গেল কই’?

ব্যাপারটা অনেকটা তাই। বাংলাদেশ এখন অপেক্ষাকৃত অধিকতর মুক্ত বাণিজ্যের দেশ। অনুমান করি, আমদানি-রপ্তানির মূল্য জিডিপির প্রায় ৪০ ভাগ। শুধু তা-ই নয়, উন্নয়ন কৌশলের দিক থেকে আমরা নাকি রপ্তানিতাড়িত কৌশল অবলম্বন করেছি, যেখানে আমাদের দেশীয় পণ্যের বিশ্ববাজারে প্রবেশগম্যতাকে অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। তেমনি অনেকটা উদার আমদানিনীতি আমাদের শিল্পায়নকে সমৃদ্ধ করছে। মোটকথা, বৈদেশিক বাণিজ্য আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করছে বলে অর্থনীতিবিদদের অভিমত।

তার পরও দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, মাত্র  কিছুদিন পূর্বে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের হিসাব নিয়ে এক হ-য-ব-র-ল অবস্থা বা  তুঘলকি কাণ্ড বিরাজ করছে বলে প্রতীয়মান হয়। অধুনা যে দুটো প্রতিষ্ঠান আমদান-রপ্তানি তথ্য সংরক্ষণে দায়িত্বপ্রাপ্ত যথা বাংলাদেশ ব্যাংক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), তাদের হিসাবের মধ্যে পর্বতপ্রমাণ পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। বালাদেশ ব্যাংক বলছে, ইপিবির প্রদত্ত তথ্যের দুই হাজার ৩৩৪ কোটি ডলারের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। স্মর্তব্য, বাংলাদেশকে এই রকম পরিস্থিতির মুখোমুখি আগে কখনো  হতে হয়নি।

বিশেষজ্ঞদের মত এই যে এর ফলে অর্থনীতির অনেক হিসাবই এখন পরিবর্তিত হয়ে যাবে। যেমন— ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) হিসাব উল্টে যাবে, ফিন্যানশিয়াল অ্যাকাউন্টেও প্রভাব পড়বে। প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের হিসাবেও পরিবর্তন আসবে। কারণ জিডিপি, প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় হিসাবের অন্যতম অংশীদার রপ্তানি আয়। কান টানলে যেমন মাথা আসে, তেমনি এগুলো বৃদ্ধি বা হ্রাস পায়  রপ্তানি বৃদ্ধি বা হ্রাস সাপেক্ষে।

দুই.

একটু বিস্তারিত বলা যাক। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ইপিবির হিসাবে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) চার হাজার ৫৬৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যা কি না  বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে  তিন হাজার ৬১৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে রপ্তানি কম হয়েছে ৯৫৪ কোটি ডলারের। অন্যদিকে একই সূত্রের খবর, সদ্যোবিদায়ি অর্থবছর ২০২৩-২৪ সালের প্রথম ১০ মাসে চার হাজার ৭৪৭ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে বলে ইপিবির হিসাব। এর বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রপ্তানি হয়েছে তিন হাজার ৩৬৭ কোটি ডলারের। অর্থাৎ তাদের হিসাবে রপ্তানি এক হাজার ৩৮০ কোটি ডলার কম।

দুধ-বিড়ালের গল্প এবং রপ্তানি আয়ের হিসাববিদায়ি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস এবং এর আগের অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস মিলিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব ইপিবির হিসাবের চেয়ে ২৫ শতাংশ কম বলে অনুমান করা হচ্ছে। দুধ-বিড়ালের গল্পের মতো এখন প্রশ্ন হলো, ইপিবির হিসাবের রপ্তানি আয় কোথায় গেল?  যদি না গিয়ে থাকে, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক এত কম ওজন দেখাচ্ছে কেন? নাকি ইপিবি কৃতিত্ব প্রদর্শনের নিমিত্ত রপ্তানি আয় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখিয়েছে? তাই বা কেমন করে হয়! যদিও নিশ্চিত নই, কারণ সরকারি অনেক সংস্থা মন্দটা কম দেখায়, ভালোটা বেশি দেখায়—‘রাজা যত বলে পারিষদ বলে তার শত গুণ’।

তিন.

স্বভাবতই এমন লেজেগোবরে অবস্থায় ব্যালান্স অব পেমেন্টে (বিওপি) প্রভাব পড়তে শুরু করেছে—এক ধাক্কায় বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় চার গুণেরও বেশি বেড়েছে। এর ফলে চলতি হিসাবের ভারসাম্য উদ্বৃত্ত থেকে ঘাটতিতে রূপ নিয়েছে। যেমন—মার্চ পর্যন্ত চলতি হিসাবে প্রায় ৫৮০ কোটি ডলার উদ্বৃত্ত দেখানো হলেও এপ্রিলে এসে সেটি প্রায় ৫৭৩ কোটি ডলারের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে।

যেহেতু চলতি হিসাব আর আর্থিক হিসাব একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ, বিপরীত পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে দেশের ফিন্যানশিয়াল অ্যাকাউন্টে। গত দুই অর্থবছরেই আর্থিক হিসাবের বড় ঘাটতি নিয়ে উদ্বেগে ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক, কিন্তু সেও উদ্বেগ হিসাবের মারপ্যাঁচে উবে গিয়ে যেন উল্লাসে রূপ নেওয়ার মতো অবস্থা—আর্থিক হিসাবে ঘাটতি থেকে উদ্বৃত্তের উঠের পিঠে চলছে স্বদেশ!

এই পরিস্থিতির কারণ নিয়ে  বাংলাদেশ ব্যাংকের উত্তর হচ্ছে, ‘রপ্তানির তথ্য আমরা ইপিবি থেকে পাই। সংস্থাটি এত দিন যে তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংককে দিয়েছে, সেটির ভিত্তিতেই বিওপির হিসাবায়ন করা হয়েছে। ইপিবি এখন রপ্তানির সংশোধিত তথ্যে ব্যাংকের কোনো দায় নেই। ’ সত্যি কথা, কিন্তু ইপিবি এ পর্যন্ত স্পিকটি নট। কিন্তু অন্ধ হলেই যে প্রলয় বন্ধ হয় না।

চার.

রপ্তানি আয়সংক্রান্ত তথ্যবিভ্রাটের পেছনের কারণগুলো নিম্নরূপ হতে পারে বলে আমাদের ধারণা।  এক. যেকোনো কারণেই হোক, ইপিবি ওভার রিপোর্টিং করেছে। দুই. আরেকটা হলো পাকিস্তান আমলের মতো  রপ্তানি বেশি দেখিয়ে রপ্তানিকারকরা সাবসিডির সুবিধা নিয়েছে। এবং অবাক নয় যে এ ধরনের ‘ম্যানিপুলেশনে’ রপ্তানিকারক ও কাস্টমস দুই পক্ষই আর্থিক সুবিধাপ্রাপ্ত হয়ে থাকতে পারে। তিন. এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যে পরিমাণ রপ্তানি করা হয়েছে  তার বিপরীতে সেই পরিমাণ অর্থ দেশে আনা হয়নি। সোজা কথায় অর্থপাচার হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে।

মনে রাখা দরকার এবং বিশেষজ্ঞদের অভিমত, রপ্তানি আয় যদি দেশে আনা না হয়ে থাকে, তাহলে সেটা আনা যাবে। কিন্তু অন্য দুই কারণে হয়ে থাকলে দেশে অর্থ আসবে না।

পাঁচ.

এ রকম আমদানি-রপ্তানির হিসাবে এমন ‘অরাজক’ পরিস্থিতি অকল্পনীয় এবং এর প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী। আগেও বলা হয়েছে, এর ফলে অর্থনীতির অনেক হিসাবই এখন পাল্টে যাবে—কারেন্ট অ্যাকাউন্ট সারপ্লাস থাকার কথা, কিন্তু হয়ে গেছে নেগেটিভ। ফিন্যানশিয়াল অ্যাকাউন্ট নেগেটিভ থাকার কথা কিন্তু সেটা হয়ে গেছে পজিটিভ। ফিন্যানশিয়াল অ্যাকাউন্ট  যদি  পজিটিভ হবে, তবে রিজার্ভ বা ডলারের সরবরাহ নিয়ে এত উদ্বেগ-উত্কণ্ঠার উৎস কী? একটা যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে এই এনম্যালির সঠিক কারণ নির্ণয় করা দরকার বলে আমরা মনে করি। আবার শুধু তদন্ত বা কারেকশন করলেই হবে না, দায়ীদের চিহ্নিত করতে হবে, ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের তথ্য কারচুপি না হয়  তার ব্যবস্থা নিতে হবে।

শুধু রপ্তানি নয়, আমদানির হিসাবেও ঝামেলা আছে বলে অনেকের ধারণা। কখনো কখনো আমদানির উল্লম্ফন সন্দেহের উদ্রেক করে। জানতে হবে, আসলেই কি বাংলাদেশে বিশেষ কিছু ঘটছে, যার জন্য আমদানি অতি দ্রুত বাড়ছে না নিছক ওভার ইনভয়েসিং বা ডলার পাচার; নাকি বাংলাদেশের আমদানীকৃত পণ্য অন্য জায়গায় যাচ্ছে।  

ছয়.

সন্দেহ নেই যে সঠিক তথ্য-উপাত্তের অনুপস্থিতিতে অর্থনীতির স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না। সঠিক পরিকল্পনা নিতে হলে কিংবা অভিক্ষেপণের জন্য সঠিক উপাত্তের বিকল্প নেই। মোটকথা, অর্থনীতির একটা বাস্তব চিত্র পেতে হলে এসব এনম্যালি অতি দ্রুত দূর করা দরকার। বাংলাদেশ যে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ বলে প্রচার করা হচ্ছে তা যে মিথ্যা, বানোয়াট তথ্যের ওপর নয়; বরং বাস্তবসম্মত পরিসংখ্যান একই কথা বলবে বলে আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস।

আমরা বহুদিন থেকে যুক্তি দেখিয়ে আসছি যে আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্য খাত বিদেশে অর্থপাচারের অন্যতম প্রধান উৎস। রপ্তানি কম দেখিয়ে কিংবা আমদানি বেশি দেখিয়ে বিদেশে অর্থ পার্ক করা হয়। প্রতিবছর সাত-আট বিলিয়ন ডলার পাচারের একটা বড় অংশ এই ‘টেকনিক্যাল স্মাগলিং’, যা বৈধ পথে অবৈধ বাণিজ্যের শামিল।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইপিবির মধ্যকার হিসাবের গড়মিল অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সেটা করা হবে ততই মঙ্গল।

 লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়