আয়নাঘরের নির্মম নির্যাতনের কথা জানালেন সাবেক রাষ্ট্রদূত

সরকার পতনের পর থেকে ‌‘আয়নাঘর’ নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সেখানে নিয়ে নির্যাতনের নানা ঘটনা উঠে আসছে ভুক্তভোগীদের বর্ণনায়। জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আহমাদ বিন কাসেম (আরমান), মাইকেল চাকমা, সাবেক রাষ্ট্রদূত এম মারুফ জামানসহ অনেককে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আয়নাঘরে।

আয়নাঘরে দীর্ঘ প্রায় ১৬ মাস বন্দি ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম মারুফ জামান। সে সময় থেকে তাঁর পরিবারের ওপর নজর রাখছিল বলেও জানান তিনি।

২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে ছোট মেয়েকে আনতে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গিয়ে নিখোঁজ হন মারুফ জামান। পরে ২০১৯ সালের ১৬ মার্চ তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। আয়নাঘরের নির্মম নির্যাতনের কথা এতোদিন বলতে না পারলেও শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দেশের এক গণমাধ্যমে সম্প্রতি মুখ খুলেছেন তিনি।

সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, আমি গাড়ি চালানোর সময় লক্ষ্য করি একটি মাইক্রোবাস পেছন থেকে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে বিমানবন্দরের কাছে গাড়ি আটকিয়ে সাধারণ পোশাকধারী ব্যক্তি গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে নিয়ে যায়। সেখানে আরও কয়েকজন ব্যক্তি ছিল। তারা তাঁর চোখ ও হাত বেঁধে মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে দেয় বলে জানান তিনি।

তিনি বলেন, প্রায় ২০ মিনিট মাইক্রোবাসটি চলার পর থামে। কোথায় যাচ্ছি বুঝতে না পারলেও পরবর্তীতে নানান কারণে বুঝতে পারেন তিনি কোনো এক সেনা নিবাস এলাকায় আছেন। সেখানে দায়িত্ব পালনকারীরা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) সদস্য।

আয়নাঘরের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ছোট একটি নোংরা ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল আমাকে। সেখানে একটি কাঠের বিছানা, একটি সিসিটিভি ক্যামেরা এবং চারটি ফ্যান ছিল। জায়গাটি মোটেই বাসযোগ্য ছিল না।

তিনি বলেন, বিভিন্ন সময়ে এই কক্ষে অনেককে আটকে রাখা হয়েছে। অনেকে দেয়ালে তাদের নাম, ঠিকানা ও তারিখ লিখে রেখেছিলেন। তিন মাস পরপর এসব দেয়াল রং করা হতো।

'সেনা' পানির বোতল, ওষুধ এবং সামরিক রেফারেন্সসহ কোরআনের একটি কপিসহ নানান কিছু দেখে নিশ্চিত ছিলেন তিনি কোনো এক সেনানিবাসে আছেন। বলেন, আমি এক বোতল পানি খেয়ে শেষ করার পরে তারা আমাকে সেনা নাম লেখা আরেকটি বোতল দেয়। আমাকে যে ওষুধ দিয়েছিল সেটার স্ট্রিপে লেখা ছিল ডিফেন্স মেডিসিন, বিক্রয় নিষিদ্ধ। '

মারুফ বলেন, তারা আমার ল্যাপটপ চেয়েছিল। আমি প্রথমে দিতে না চাইলেও মারধর শুরু করলে আর না দিয়ে পারিনি। পরে তারা আমার বাসা থেকে ল্যাপটপগুলো নিয়ে যায়।

এই কূটনীতিবিদ আরও বলেন, তারা এমন কিছু লোকের বিষয়ে আমার কাছে জানতে চেয়েছে, যাদের আমি চিনি না। তারা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কিছু চুক্তির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল। এটাও জানতে চেয়েছিল, আমি কীভাবে জানলাম যে ভারতীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।

মারুফ বলেন, তারা বারবার জিজ্ঞাসা করেছে যে আমি কেন আন্তর্জাতিক অনলাইন প্ল্যাটফর্মে সরকারবিরোধী নিবন্ধ লিখলাম।

তিন দিন পর পর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো বলে জানান তিনি।  জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার মুখে আঘাত করা হয় বলেও জানান তিনি। বলেন, আঘাতে আমার মুখ দিয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয় এবং দাঁতে সমস্যা হয়ে যায়। তারা আমাকে লাঠি দিয়ে হাত ও পায়ে মারধর করে। কিন্তু কোনো প্রকার চিকিৎসা দেয়নি। রাতের বেলায় হাতে করে ওষুধ নিয়ে আসত। বলতাম এতো কম কেন? উত্তরে বলতো যা পাইছ তাই খাও। বেশি কথা বললে এটাও বন্ধ হয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, বাথরুমে নিতো দিনে ৪ বার। যখন কোনো নতুন লোক আসতো ফ্যানের শব্দ হতো জোরে। বাইরের যেন আওয়াজ না আসে। নতুন যে কেউ আসলেই সেন্ধ করা ডিম পায়ুপথ দিয়ে ডুকিয়ে দিয়ে নির্যাতন করা হতো। নির্যাতনের লেভেল ভাগ করা ছিলো বলেও জানান তিনি। গ্রেড-২, গ্রেড-৩ এই ধরনের।

তিনি বলেন, আমাকে যেখানে রাখা হয়েছিল সেটা গ্রেড-২ লেভেল ছিলো বলেই জানতাম।  গ্রেড-২তে নির্যাতন এমন ছিলো যে, ঘুমাতেও পারবো না, আলো জ্বলবে, শব্দ প্রচুর। শারীরিকভাবে এমন নির্যাতন করা হয় যে বাঁচার সম্ভাবনা কম থাকে। অনেকে বাঁচে আবার অনেকেই বাঁচে না।   

বন্দি অবস্থায় ত্বকের সমস্যা, হাতের লিগামেন্টে আঘাত এবং মুখের ঘাসহ বিভিন্ন রোগে ভুগেছেন মারুফ। অবশেষে ২০১৯ সালের ১৬ মার্চ তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

এ ব্যাপারে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। রাত ১টার দিকে একজন আমাকে ডেকে তুলে একটি জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে বলা হয়, গত ১৫ মাসের বেশি সময় সম্পর্কে কোথাও যেন কিছু না বলি।

তিনি আরও বলেন, তারা পোশাক ফেরত দিলেও ল্যাপটপ রেখে দেয়। এরপর রাত ২টার দিকে মারুফের ধানমন্ডি বাসার কাছে নিয়ে যায় এবং গাড়ি থেকে নেমে পেছনে না তাকিয়ে সোজা চলে যেতে বলে।

news24bd.tv/TR