মহানবীর যুগে যেমন ছিল ধর্মীয় সহাবস্থান

প্রিয় নবী (সা.) মদিনায় হিজরতকালে (সেপ্টেম্বর ৬২২ খ্রি.) পাঁচ ধরনের মানুষের সংশ্লেষের এক নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন। যথা—মুহাজির, আনসার, ইহুদি, খ্রিস্টান, পৌত্তলিক। তখন তাঁর প্রথম ও প্রধান অগ্রাধিকার হয় ভ্রাতৃবিরোধ-বিদ্বেষ ও বিগ্রহের অবসান ঘটানো। প্রিয় নবী (সা.)-এর দর্শন—‘সহজ করো, জটিল কোরো না। সুসংবাদ দাও, ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিয়ো না। ’ (বুখারি)

এই নীতিতে ‘শান্তি ও আনুগত্য-আত্মসমর্পণ’ তথা Peace & Submission-এর শিক্ষায় তিনি Social contract বা সামাজিক চুক্তির মতো সম্প্রীতিমূলক ‘মদিনা সনদ’ প্রণয়ন করেন।

মদিনা সনদের প্রধান অর্জন—

(ক) তাওহিদভিত্তিক লিখিত সনদের আলোকে সংঘাতের স্থলে সর্বজনীন নিরাপত্তা।

(খ) প্রিয় নবী (সা.)-এর নেতৃত্বে শান্তি ও রাজনৈতিক ঐক্য।

(গ) সাম্য ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তা। মদিনা সনদের ফলে অসাম্প্রদায়িকতা ও সহিষ্ণুতার পরিবেশ গড়ে ওঠা সহজতর হয়। মদিনা সনদকে বলা হয়, মানব ইতিহাসের প্রথম লিখিত সংবিধান Written constitution.

সনদের সারসংক্ষেপ

(ক) মুসলিম, ইহুদি, খ্রিস্টান ও পৌত্তলিক সমান নাগরিক অধিকার ভোগ করবে।

(খ) রাসুলুল্লাহ (সা.) হবেন নব গঠিত ‘মদিনা প্রজাতন্ত্রে’র প্রধান ও সর্বোচ্চ বিচারালয়ের Court of Appeal-এর সর্বময় কর্তা।

(গ) সবার পরিপূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকবে, এতে কোনো হস্তক্ষেপ করা যাবে না।

(ঘ) কোনো ব্যক্তির অপরাধের দায়ে তার সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না।

(ঙ) দুর্বল, অসহায়কে সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।

(চ) সনদ স্বাক্ষরকারী পক্ষগুলোর মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে রাসুল (সা.) তা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী মীমাংসা করবেন।

মদিনা সনদের মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (সা.) ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্ব বৃদ্ধি পায়, ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি রচিত হয়, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও মদিনার পুনর্গঠন সম্ভব হয়। মদিনা সনদের ধারাবাহিকতায় প্রিয় নবী (সা.) গোত্রপ্রধান শাসিত ২৭৬টি দেশীয় রাজ্যকে একত্র করেন। মদিনাকেন্দ্রিক এ ব্যবস্থার বিস্তৃতি ছিল ১০-১১ লাখ বর্গমাইলেরও বেশি এলাকা। পরবর্তী সময়ে প্রিয় নবী (সা.) সংঘাতের স্থলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যই ষষ্ঠ হি./ ৬২৮ খ্রি. ‘হুদাইবিয়া’র সন্ধি স্বাক্ষর করেন। হুদাইবিয়ার সন্ধির ফলে মক্কা-মদিনার মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ স্থগিত থাকার সুবাদে প্রিয় নবী (সা.) ইসলাম প্রচারে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। ফলে প্রিয় নবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় ইসলাম আন্তর্জাতিকরূপ পরিগ্রহ করে। যার ভিত্তি হলো—

উম্মাহ (অভিন্ন জাতীয়তাবোধ ও অখণ্ডতা),

উখওয়াৎ (বিশ্বজনীন ইসলামী ভ্রাতৃত্ব),

তাবলিগ (ধর্মীয় প্রচার) ও

খিদমতে খালক (সৃষ্টির সেবা-সংরক্ষণ)।

এই চেতনাবোধের সার্থকতায় প্রিয় নবী (সা.) পত্রাবলি অনন্য কিংবদন্তি ও প্রিয় নবী (সা.)-এর চলন্ত-জীবন্ত মুজিজা। মিসরীয় গবেষক ড. হামিদুল্লাহর মতে, প্রিয় নবী (স.) যাঁদের কাছে পত্র পাঠিয়েছিলেন তাঁদের সংখ্যা দু-আড়াই শর কম নয়। তাঁদের অন্যতম হলেন—

রোম সম্রাট (কায়সার) হিরাক্লিয়াস,

ইয়ামামার গভর্নর হাওয়া বিন আলী,

বাহরাইনের গভর্নর মুনজির বিন সাওয়া,

ওমানের গভর্নর জাফর বিন জুলান্দি,

দামেস্কের গভর্নর হারিস বিন আবি শামর গাসসানি,

আবিসিনিয়া বা হাবশার বাদশাহ নাজ্জাসি আসহাম,

মিশররাজ মাকাওকাস এবং ইরানের শাহানশাহ কিসরা খসরু পারভেজ।

রোম সম্রাটের কাছে লিখিত পত্রের ভাষ্য—

প্রিয় নবী (সা.)-এর পবিত্র পত্র পাঠে রোম সম্রাট হিরাক্লিয়াসের মনোজগতে ঝড় বইতে শুরু করে। তিনি প্রিয় নবী (সা.)-এর নবুয়তের সত্যতা নিশ্চিত হয়ে বলেছিলেন—‘হায়! আমি যদি তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারতাম! তবে আমি তাঁর পা ধুয়ে দিতাম। ’ (বুখারি)

শুধু তাই নয়, তিনি রাজপ্রাসাদে রোমের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সামনে ঘোষণা করলেন : ‘হে রোমবাসী। তোমরা কি কল্যাণ, হিদায়াত এবং তোমাদের রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব চাও? তাহলে এই নবীর আনুগত্য (বাইআত) গ্রহণ করো...’ (বুখারি)

বস্তুত এভাবেই ইসলাম ‘বিশ্ব বিজয়ী ধর্ম’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়, এতেও আল-কোরআনের বাণীর নিত্যতা প্রমাণিত হলো : ‘তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মনে সম্প্রীতি দান করেছেন, এখন তোমরা তাঁর অনুগ্রহের কারণে পরস্পর ভাই ভাই হয়েছ...। ’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১০৩)