৬৪ জেলার মাটি দিয়ে মানচিত্র!

মাটির মানচিত্র হাতে এর কারিগর শুভঙ্কর শুভ

৬৪ জেলার মাটি দিয়ে মানচিত্র!

নিউজ টোয়েন্টিফোর ডেস্ক

গোটা দেশটা ঘুরে দেখার ইচ্ছে ছিল তার। কিন্তু তাতে পরিবারের সম্মতি মেলেনি। ইচ্ছেটা তাই ইচ্ছেতেই রয়ে যায়।

বাস্তবে সেই ইচ্ছে পূরণ না হলেও কম্পিউটারে বসে গুগল ম্যাপে ভার্চুয়াল স্কিনে ঘুরতেন ৬৪ জেলা।

এর মাঝেই হঠাৎ করেই তার মনে হলো- এক জায়গা থেকেই যদি সত্যি সত্যি বাংলাদেশটাকে ছুঁয়ে দেখা যায়, তবে কেমন হয়?

তার মতো অনেকেই তো পরিবারের সম্মতি না পেয়ে কিংবা অর্থ ও সময়-সুযোগের অভাবে ৬৪ জেলা ঘুরতে পারে না।  
তাই বলে কি তারা ৬৪ জেলায় না ঘুরেও একটি স্থান থেকেই বাংলাদেশটাকে ছুঁয়ে দেখতে পারবে না?

এমন ইচ্ছে থেকে ৬৪ জেলার মাটি দিয়ে বাংলাদেশের মানচিত্র বানালেন এক শিক্ষার্থী। নাম তার শুভঙ্কর পাল শুভ। বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলায়।

পড়ালেখা করছেন রাজধানীর স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের শেষ বর্ষে।

আগামী ৩ অক্টোবর ফরিদপুর জেলা উন্নয়ন মেলায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হবে দেশের সবকটি জেলার মাটি দিয়ে বানানো মানচিত্রের।  

অনবদ্য সৃজনশীলতার এই গল্পটা সবাইকে নিজ মুখেই শোনালেন শুভঙ্কর, ‘আমার ইচ্ছে ছিল ৬৪ জেলা ঘুরে দেখার। কিন্তু পরিবার থেকে এ বিষয়ে সমর্থন পাইনি। কী আর করার? মন খারাপের পাল্লা হলো ভারি। মাঝে মাঝে কম্পিউটারে গুগল ম্যাপে ৬৪ জেলা ঘুরতাম ভার্চুয়াল স্ক্রিনে। একদিন হঠাৎ মনে হলো, এমন যদি হতো এক জায়গা থেকেই বাংলাদেশটাকে ছুঁয়ে দেখবো। স্পর্শ করবো গোটা দেশকে। শুধু আমি নই, আমার মতো যারা ৬৪ জেলা ঘুরে দেখার ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারে না; তারাও ইচ্ছে করলে ৬৪ জেলায় না গিয়েও একটি স্থান থেকেই বাংলাদেশটাকে স্পর্শ করতে পারবে। আইডিয়াটা এভাবেই মাথার মধ্যে চেপে বসলো। ’

‘সাথে সাথে এটাও মনে হলো বাংলাদেশ নামটি দিয়ে এমন কিছু করার প্রয়োজন, যা হবে একদম নতুন। আগে কখনো এই নামটি নিয়ে এরকম কিছু হয় নি। হ্যাঁ, বাংলাদেশের মানচিত্র অনেক জায়গায় আছে কিন্তু ৬৪ জেলার মাটি এক ফ্রেমে কি আনা হয়েছে? দেখলাম অনলাইনে ঘেটে। নো রেজাল্ট। শুরু করলাম কাজ’- বলছিলেন শুভঙ্কর।

কাগজ দিয়ে টুকিটাকি শিল্পকর্ম করার হাত আগে থেকেই ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই যেমন কাগজের তাজমহল, কাগজের বায়োস্কোপ, ক্যামেরা ইত্যাদি। এই অভিজ্ঞতাটুকু কাজে লাগালাম ৩ দিন ধরে বাংলাদেশের ম্যাপের ওপর ৬৪ জেলার জন্য ৪৬ জেলার কাগজের বক্স তৈরি করলাম। তারপর ফ্রেম তৈরি করলাম। এরপর মূল কাজ, তবে বেশ চ্যালেঞ্জিং। ’ 

‘৬৪ জেলা থেকে মাটি আনতে হবে। প্রথমত নিজে কয়েক জেলার মাটি সংগ্রহ করলাম। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতা চাইলাম। আমি চেয়েছিলাম আমার এই মানচিত্রে ৬৪ জেলার ৬৪ হাতের ভালবাসাময় স্পর্শ লেগে থাকুক। কেউ যেন অবহেলা করে মাটি সংগ্রহ না করে। এভাবে স্বেচ্ছায় আগ্রহ নিয়ে মাটি সংগ্রহ করে পাঠায় সবাই। ’

শুভঙ্কর জানান, প্রথম দিকে অনেকেই তার কাজকে গুরুত্ব দেয়নি। আবার অনেকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছে। এরপর তিনি তার আইডিয়াটা নিয়ে একটি ভিডিও বানিয়ে ইউটিউব, ফেসবুক এবং বিভিন্ন ব্লগে শেয়ার করেন। প্রকাশের পর থেকে সাড়া দেয় অনেকেই। অনেকে সহযোগিতা করতেও এগিয়ে আসে। বিভিন্ন জেলা থেকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাটিও আসা শুরু হয়।

মিডিয়ার এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার স্বপ্ন আর আমার একার স্বপ্ন থাকে না । ছড়িয়ে পড়ে একঝাঁক মাটি সংগ্রাহকের মধ্যে। সবারই প্রত্যাশা একটিই ছুঁয়ে দেখবো গোটা বাংলাদেশ। এ যেন মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী একটি প্রজন্মের নতুন করে হাতে হাতে বাংলাদেশ গড়ার মিশন। ’

মানচিত্রটি গড়তে গিয়ে একটা পর্যায়ে মন ভেঙ্গে যায় বলে জানান তিনি। বলেন, ‘অনেকে মাটি দিতে চেয়ে দেয়নি। মাটি সংগ্রহকালীন ছবি পাঠিয়ে মাটি পাঠায়নি। বার বার ফোন দিয়েছি পরে বিরক্ত প্রকাশ করেছে। এ বিষয়টি আমাকে প্রচণ্ড কষ্ট দিয়েছে। ’

news24bd.tv

‘বার বার মনে হয়েছে ৫০০ গ্রাম মাটিই তো। এত বন্ধু কত দূরের জেলা থেকে পাঠালো আর কিছু মানুষ শুধুই ঘোরাচ্ছে। তাহলে কি আমার মানচিত্র গড়ার স্বপ্নটি ব্যর্থ হবে? আমি চাইলেই ১৫-২০ টা জেলার মাটির জন্য আর একটু বেশি প্রচার চালালে সংগ্রহ করতে পারতাম। ’

‘কিন্তু আমি চাইনি এটা জোর করে হোক। সবার ভালবাসা লেগে থাকুক মাটির মানচিত্রে। এভাবেই ৩ বছর কেটে যায় প্রজেক্টটি নিয়ে। নিজে থেকে এগোয়নি। ভেবেছিলাম নিজে বাকি জেলার মাটি নিজ হাতে সংগ্রহ করবো। কারণ, ফেসবুকে পোস্ট করলে অনেকেই বলত নিজে ফেমাস হওয়ার জন্য এসব করছি। এটাও খুব কষ্ট দিত। আর আমার মাটির মানচিত্রের অপমান হোক এটা চাইনি। তাই কার্যক্রমটি অনেকদিন স্থগিত থাকে। ’

সর্বশেষ মানচিত্রের মাটি যারা সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন সবাই মানচিত্র কবে উন্মুক্ত হবে এই নিয়ে তোর-জোড় শুরু করে। আবার প্রচার শুরু করেন শুভঙ্কর। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক বিষয়টি জানতে পেরে আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং নিজেও তাকে সংগ্রহ করে দেন বেশ কয়েক জেলার মাটি।  

অবশেষে প্রায় ৩ বছর ধরে কাজ করার পর মাটির মানচিত্র তৈরির কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। আগামী ৩ অক্টোবর ফরিদপুরের জেলা উন্নয়ন মেলায় জেলা প্রশাসক এই মাটির মানচিত্রটির উদ্বোধন করবেন বলে জানান শুভঙ্কর।

আগামীতে এই মানচিত্র কোথায় রাখা হবে জানতে চাইলে শুভঙ্কর পাল বলেন, ‘পরবর্তীতে জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ যদি এই মানচিত্রটিকে জাদুঘরে রাখতে চায়, তাহলে আমার দিতে আপত্তি নেই। ’

পরিশেষে শুভঙ্কর সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘একঝাঁক মাটি সংগ্রাহক, যাদের অবদান ছাড়া এই মানচিত্র আলোর মুখ দেখত না; তাদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আমি কেবল স্বপ্ন দেখেছিলাম মানচিত্র গড়ার কিন্তু আপনারা যারা মানচিত্রের মাটি সংগ্রাহকের তালিকায় নাম লিখেয়েছেন, আপনারাই এই মানচিত্রের প্রকৃত কারিগর। যতদিন এই মানচিত্র থাকবে, ততদিন আপনাদের নাম থাকবে। ’


অরিন▐ NEWS24

সম্পর্কিত খবর