রেল যাত্রীদের মাঝে হিজড়া আতঙ্ক!

মারুফা হিজড়া, রুমা হিজড়া ও ঝর্ণা হিজড়ার সেলফি

রেল যাত্রীদের মাঝে হিজড়া আতঙ্ক!

নাসিম উদ্দীন▐ নাটোর প্রতিনিধি

উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ৮টি আন্তঃনগর ট্রেনে হিজড়াদের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে যাত্রীরা। হিজড়ারা প্রতিদিন দল বেঁধে কোনো না কোনো ট্রেনে উঠে চাঁদাবাজি করে। এদের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি ও মারমুখী আচরণে আতঙ্কিত ও বিব্রত যাত্রীরা তাই চাঁদা দিতে বাধ্য হয়।  

ট্রেন তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ট্রেনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদাসীনতায় এ ধরনের ভোগান্তির মুখে পড়তে হচ্ছে বলে যাত্রীরা অভিযোগ করেছেন।

উত্তরাঞ্চলের পার্বতীপুর থেকে ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুর রুটে ৮টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। এগুলো হলো- নীলসাগর, একতা, দ্রুতযান, বরেন্দ্র, তিতুমীর, সীমান্ত, রূপসা ও লালমনি এক্সপ্রেস।  

এর মধ্যে ৭টি আন্তঃনগর ট্রেন সীমান্তবর্তী  হিলি স্টেশন হয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে চলাচল করে। ওই সব ট্রেনে প্রতিদিন নাটোরের মারুফা হিজড়া, রুমা হিজড়া, ঝর্ণা হিজড়া, একা হিজড়া ও পাতা হিজড়ার নেতৃত্বে সক্রিয় ৫টি দল পার্বতীপুর, রংপুর, নীলফামারী, দিনাজপুর, জয়পুরহাট অঞ্চলের ট্রেনে দল বেঁধে উঠে পড়ে।

তারপর শুরু করে গণহারে টাকা আদায়।  

কেউ টাকা দিতে না চাইলে চাঁদা দাবি করা হিজড়া সম্প্রদায়ের সদস্যরা নানা বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করে। এ অবস্থা থেকে বাঁচতে যাত্রীরা তখন চাহিদামতো টাকা দিয়ে হিজড়াদের বিদায় করতে বাধ্য হয়।
news24bd.tvnews24bd.tv

ভুক্তভোগী যাত্রীরা অভিযোগ করেন, ট্রেনে কর্মরত রেল পুলিশসহ অন্য কর্মচারীরা যাত্রীদের সুবিধা-অসুবিধা দেখার চেয়ে বিনা টিকিটের যাত্রী ও চোরাচালান কারবারীদের কাছ থেকে ঘুষ নিতে ব্যস্ত থাকেন। তাই হিজড়াদের হাতে যাত্রী হয়রানি বন্ধে তারা কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না।

ট্রেনে নিয়মিত যাতায়াতকারী বেশ ক’জন যাত্রীর অভিযোগ, নাটোর থেকে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী ট্রেনগুলোতে হিজড়ার কয়েকটি দল নিয়মিত চাঁদাবাজি করছে। প্রতিদিন বিভিন্ন ট্রেনের কয়েকশ যাত্রী হিজড়াদের অশ্লীলতায় নাজেহাল হচ্ছে। চাঁদা আদায়ের সময় যাত্রীদের পরনের কাপড় ধরে টানাটানি করে। এমনকি মারামারিতে লিপ্ত হচ্ছে হিজড়ার দল। এসব নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হলেও যেন দেখার কেউ নেই।

সরেজমিনে দেখা গেছে, একদল হিজড়া নাটোর থেকে পার্বতীপুরগামী রূপসা এক্সপ্রেস ট্রেনের জনৈক যাত্রীকে বলছে, ‘অ্যাই পঞ্চাশ টাকা দেন, না দিলে কিন্তু মেশিন ধরবো। ’ তাদের আচরণের অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি যাত্রীদের বিব্রতরকর অবস্থায় ফেলে। ছাত্র-শ্রমিক যেই হোক, হিজড়াদের অশ্লীলতা থেকে কেউ ছাড় পাচ্ছে না। রাগান্বিত হলে যাত্রীর পরনের কাপড় খুলতেও দ্বিধা করে না তারা।

ট্রেনের টিকেট চেকার আবুল হোসেন জানান, হিজড়াদের চাঁদাবাজি থামানো যাচ্ছে না। কিছু বলতে গেলে তারা শুধু শরীরেই হাত দেয় না, পরনের কাপড় খুলে গোপনাঙ্গেও হাত দেয়। অসম্মান বোধে তাদের বাধা দেয়া যাচ্ছে না।

যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য ট্রেনে যে কয়েকজন পুলিশ থাকে, তারা হিজড়াদের সঙ্গে কুলিয়ে উঠতে পারে না। যাত্রীদের জিম্মি করে টাকা আদায় করা ওদের প্রধান কাজ। টাকা না দিলে হিজড়ারা এমন কিছু কাজ করে, যাতে মান-সম্মানের হানি হয়। আবার টাকার জন্য যাত্রীদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে এমন ঘটনা ঘটছে অহরহ।  

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও রেল পুলিশের পরোক্ষ সহযোগিতায় হিজড়ারা ট্রেনে চাঁদাবাজি করে। হিজড়াদের দ্বারা আক্রান্ত হলে পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয় না।  

রেল পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সামনেই হিজড়ারা চাঁদাবাজি করে, যাত্রীদের সাথে অশালীন আচরণ করে। এ জন্য অনেকেরই সন্দেহ, হিজড়াদের চাঁদাবাজির টাকার ভাগ পায় পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী।  

এক প্রত্যক্ষদর্শী যাত্রী জানান, গেল ২১ সেপ্টেম্বর নাটোর রেল স্টেশনে হিজড়ারা টাকা না পেয়ে নাহিদ হাসান নামে একজন যাত্রীকে পিটিয়ে আহত করে মারুফা,রুমা, ঝর্ণা ও পাতা হিজড়া। এ সময় নাহিদের কাছ থেকে নগদ ৫০ হাজার টাকা, সোনার আংটি এবং পাসপোর্ট কেড়ে নেয় তারা ।  

ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে রেল পুলিশ হিজড়াদের বিচার তো করেই নি, উল্টো তাদের পক্ষে সাফাই গেয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলের স্টেশনগুলোতে প্রতিনিয়ত হিজড়াদের দ্বারা লাঞ্ছিত, অপমানিত হচ্ছেন যাত্রীরা। দল নিয়ে থাকে বলে তাদের চাঁদাবাজি ও অপকর্মের প্রতিবাদ করার সাহস করে না যাত্রীরা।  

একইভাবে গেল ১৬ সেপ্টেম্বর জাহিদ হোসেন নামে এক যাত্রী চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে হিজড়ারা বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে মারুফা, বাপ্পী ও ঝর্ণা হিজড়া এলোপাথাড়ি মারপিট করে এবং জাহিদের গায়ে টগবগে গরম পানি ঢেলে ঝলসে দেয় । চাঁদা না দেওয়ায়  এই একই গ্রুপের হিজরাদের হাতে গেল এক মাসে অন্তত ২০জন ট্রেন যাত্রী মারপিটের স্বীকার হযেছে।

এ প্রসঙ্গে পশ্চিমাঞ্চলের নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) চিফ কমান্ড্যান্ট শাহ আলম ভূঁইয়া বলেন, ‘যেসব স্টেশনে আরএনবি ইউনিট আছে, সেসব স্টেশন থেকে হিজড়ারা ট্রেনে উঠতে পারে না। তারপরও যে তারা একেবারে ওঠে না তা নয়। ’

তিনি বলেন, ‘রেল পুলিশ হিজড়াদের বিরুদ্ধে বহু মামলা দিয়েছে। তারপরও তাদের উৎপাত কমেনি। বরং তারা কৌশল পাল্টে ট্রেনে উঠছে। একজন হিজড়া টিকিট কেটে ট্রেনে উঠলে আমাদের কিছুই করার থাকে না। ’

এ ব্যাপারে বগুড়ার সান্তাহার রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকবর হোসেন  জানান, ‘নাটোর কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা হিজরাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। ইতোমধ্যে আমরা তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছি। ’

‘আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে হকার, ভিক্ষুক ও হিজড়াদের অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ইতোমধ্যে রেলওয়ে পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশ অমান্য করা হলে সংশ্লিষ্ট ট্রেনের কর্তব্যরত গার্ড, টিটিই, অ্যাটেনডেন্ট ও দায়িত্বরত রেল পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’


নাসিম▐ অরিন▐ NEWS24

সম্পর্কিত খবর