মৃত্যুর আগে মানুষ কী করতে চায়?

প্রতীকী ছবি

মৃত্যুর আগে মানুষ কী করতে চায়?

নিউজ টোয়েন্টিফোর অনলাইন

ছোট্ট একটি শব্দ মৃত্যু! এক শব্দে শেষ হয়ে যায় একটি অধ্যায়। মৃত্যু নিয়ে অনেক বছর ধরেই গবেষকরা গবেষণা করে যাচ্ছেন। কেউ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন মৃত্যুর কারণ। কেউ খুঁজছেন মৃত্যু আসন্ন হলে ওই ব্যক্তি কী কী অনুভব করে।

কেউ জানার চেষ্টা করছেন মৃত ব্যক্তির অনুভূতি আছে কিনা।  

মৃত্যু এমনই এক শব্দ, যা আমাদের নিয়ে যায় অজানা কোন রাজ্যে, যার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে কেউ যেতে চায় না। মৃত্যু আসন্ন হলে শেষবারের মতো আরেকটু বাঁচার আকুতি জাগে।

কিন্তু যখন মৃত্যুর ডাক এসে যায়, প্রিয়তমা স্ত্রী,  আদরের সন্তান, বাবা-মা কেউ তাদের বন্ধন দিয়ে ধরে রাখতে পারে না। আমরা প্রতি মুহূর্তে এই মৃত্যুকে নিজের সাথে বয়ে বেড়াই। কেউ জানি না এক মিনিট পরে এই পৃথিবীতে আর বেঁচে থাকবো কিনা।  

তবে অনেকেই হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়েন, যাদের সম্পর্কে চিকিৎসকরা মৃত্যুর একটা সম্ভাব্য দিনক্ষণ জানিয়ে দেন। কেউ কেউ নিজেই টের পান তার আর বেশি সময় হাতে নেই। যখন কারো মৃত্যু আসন্ন হয় তখন তিনি কী ভাবেন? মৃত্যুর আগে মানুষ কি কোনো বিশেষ বার্তা বা ইঙ্গিত পেয়ে যায়? তিনি কী কিছু বুঝতে পারেন? তিনি কি চোখের সামনে কাউকে দেখতে পান। এসব নিয়েও গবেষণা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। এখন পর্যন্ত এ নিয়ে সঠিক তথ্য না মিললেও মৃত্যু আসন্ন ব্যক্তির সান্নিধ্যে থাকা মানুষগুলো অনেক কিছুই আঁচ করে নিয়েছেন।  তার মধ্যে প্রথম কাতারে রয়েছেন নার্স ও চিকিৎসক।

দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থ রোগীদের দেখাশোনা যারা করেন, তারা প্রায়ই খেয়াল করেছেন মৃত্যুর আগে রোগীরা তাদের মৃত্যু টের পেয়ে যান। অনেকেই মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে টের পেয়ে যান যে তিনি মারা যাচ্ছেন। অনেকে কয়েক দিন আগেই সে ঘটনা টের পেয়ে যান।

মৃত্যুর আগে মানুষ কী বলে? জীবনের শেষ কথা কেমন হয়? তাদের শেষ ইচ্ছেগুলো কেমন থাকে? সবাই কি কাঁদেন, নাকি কেউ কেউ হাসেনও? মানুষের জীবনের শেষ কথা শোনার সুযোগ সবচেয়ে বেশি পান ডাক্তার ও নার্সরা। ব্রিটেনের রয়েল স্টোক ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের একদল নার্স জানিয়েছেন মানুষের শেষ কথা। বলেছেন নিজেদের উপলব্ধির কথা।  

হাসপাতালের ম্যাকমিলান প্যালিয়েটিভ কেয়ারের নার্স লুইচ মেসি, নিকি মর্গান, ডেনি জার্ভিস, কারিনা লো ও অ্যাঞ্জেলা বিসান। তারা প্রত্যেকেই মানুষের মৃত্যু দেখেন খুব কাছ থেকে। অনেকের জীবনের শেষ কথা, শেষ কাজ, শেষ কষ্ট এবং শেষ আনন্দের সাক্ষী তারা। মানুষের চির বিদায়ের মুহূর্তগুলো কেমন হয় সে কথা জানিয়েছেন এই নার্সরা।

লুইচ মেসি বলেন, কেউ মারা যাবার সময় তার পোষা কুকুরটা যখন কাছে আসে তখন তার চেহারায় যে আনন্দ ফুটে ওঠে সেটা দেখার মতো। এই অভিজ্ঞতার কোন মূল্য হয় না।

নিকি মর্গান বলেন, এক ভদ্রলোকের শেষ ইচ্ছা ছিল তিনি মারা যাবার সময় তার বিছানায় যেন একটা রোমশ কুকুর এবং একটা অ্যালাসটিয়ান ক্রস রাখা হয়। সেটাই করেছিলাম আমরা।  

ডেনি জার্ভিস বলেন, আমরা এমন মানুষও পাই যারা মারা যাবার আগে শেষবারের মতো তাদের পছন্দের সুরা (মদ) পান করতে চান।  

কারিনা লো বলেন, কখনো কখনো তারা এককাপ চা পান করতে চান। আমার মনে হয় এটা সবাই চান।

অ্যাঞ্জেলা বিসান বলেন, সার্জিক্যাল ওয়ার্ডের পাশের এক কক্ষে ছিলেন বয়স্ক এক নারী। একই হাসপাতালে থাকা তার স্বামী গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তারা তখন অনুরোধ করেন তাদের বেড দুটি যেন একসাথে করে দেওয়া হয়। এরপর তারা হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি শুয়ে থাকেন। এসময় তারা একসঙ্গে গান গাইতে থাকেন। ১০ দিন আগে-পরে ওই ওয়ার্ডেই তারা দুজন মারা যান।  

মারা যাবার আগে মৃত্যু সম্পর্কে মানুষের ভবিষ্যদ্বাণী কেমন হয়?

নিকি মর্গান বলেন, আমরা এমন একজনকে পেয়েছিলাম যিনি বলছিলেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তার বয়স হবে ৮০। তিনি তার আশিতম জন্মদিনটি পালন করতে চান। তিনি বলেন, জন্মদিনের পার্টি করার পরই তিনি চিরতরে চলে যাবেন। আজব ব্যাপার হলো তিনি যা বলেছিলেন, সেটাই হয়েছে।

লুইচ মেসি বলেন, অনেক বছর আগের কথা। এক রোগী মারা যাবার পথে। প্রায় অচেতন অবস্থা। তিনি বলছিলেন তিনি আনন্দের সাথে মরতে চান। কারণ তিনি নাকি স্বর্গের ঝলকানি দেখতে পাচ্ছিলেন। তাই মরতে তিনি মোটেও ভয় পাচ্ছিলেন না। এটা ছিল দারুন এক অভিজ্ঞতা।

অ্যাঞ্জেলা বিসান বলেন, যেদিন আমার খালা মারা যান সেদিন সকালে আমি তার পাশেই ছিলাম। তিনি আমার ঘাঁড়ের উপর দিয়ে আমার নানির সঙ্গে কথা বলছিলেন। মারা যাবার আগে মানুষ নিজের মৃত্যু নিয়ে কী বলে খালার কথা শুনে আমার সেদিন সেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

মৃত্যুর আগে মানুষ কি অনুতাপ করে?

ডেনি জার্ভিস বলেন, আমার মনে আছে একজন বলেছিলেন, 'জীবনটা অনেক ছোট। যা করতে চান, করে ফেলেন। যেটা করে আনন্দ পান সেটাই করেন। '
নিকি মর্গান বলেন, যে কথাটা সবচেয়ে বেশি শুনি তা হলো অবসর জীবনের কথা।  

কারিনা লো বলেন, একজন আমাকে একটা কথা গোপনে বলেছিলেন। সেটা আসলে মরার প্রক্রিয়া নিয়ে। তিনি বলছিলেন,'এটা আসলে সিনেমার মতো না। টিভিতে যেমন দেখায় তেমন না। '

নিকি মর্গান বলেন, অনেকেই সারাজীবন কঠোর পরিশ্রম করেন এবং অবসরে যাবার দিনক্ষণ ঠিক করেন। এরপর তারা উপলদ্ধি করেন অবসর জীবনে তারা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং যা কিছু করতে চেয়েছেন তা আর করতে পারছেন না।  

সুখের মরণ কেমন?

এই প্রশ্নের জবাবে ডেনি জার্ভিস বলেন, আমি মনে করি সুখের মরণের বিষয়টা সত্যিই আছে। এজন্য যোগাযোগটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।  
লুইচ মেসি বলেন, মরণটা যাতে কষ্টের না হয় এজন্য মারা যাবার সময় পরিবারের সদস্যদের পাশে থাকা দরকার। অর্থাৎ, মারা যাবার সময় যেন যত্নের বিষয়টা থাকে।

এদিকে ক্যানিসিয়াস কলেজের একদল গবেষক মৃত্যু নিয়ে কয়েকটি তথ্য প্রকাশ করেছিলেন যা শুনলে চোখ কপালে উঠবে আপনারও। তাদের দাবি, মৃত্যুর কয়েক দিন আগে থেকে বা কখনও কয়েক ঘন্টা আগে, মানুষ তাঁদের প্রিয়জনদের দেখতে পান । অচেতন অবস্থাতেই অনুভব করতে পারেন তাঁদের অস্তিত্ব । শুধু তাই নয়, বিষয়টির প্রমাণ দিতে তারা একটি পরীক্ষা করেন। সেখানে একটি ঘরের মধ্যে বেশ কয়েকজন মরণাপন্ন মানুষকে তাঁরা রাখেন । তাঁদের দাবি, ওই মানুষরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন, তাঁদের শেষ সময় যত এগিয়ে আসছে, তত বেশি করে কাছের মানুষদের দেখতে পাচ্ছেন তাঁরা । অনেকে আবার জানিয়েছেন, কয়েক মাস ধরেই তাঁরা তাঁদের কাছের মানুষদের দেখতে পাচ্ছেন ।

যদিও, ক্যানিসিয়াসের গবেষকদের দাবি মানতে নারাজ অনেকেই । তাঁদের দাবি, মৃত্যুর আগে মানুষের সঙ্গে কী হয়, কেমন হয় তাঁর অনুভূতি, তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চলছে ঠিকই, কিন্তু এখনও এ বিষয়ে সঠিক তথ্য মেলেনি।

মৃত্যুর পর মানুষের শরীরে কী কী পরিবর্তন হয়?

মৃত্যুর পর শরীরের অনেকগুলি পরিবর্তন ঘটে যা থেকে মৃত্যুর সময় ও কারণ নির্ণয় করা যায়। মারা যাবার পরপরই পার্শ্ববর্তী পরিবেশের প্রভাবে দেহ ঠান্ডা হয়ে যায়, যাকে বলে Algor mortis। এটাকে মৃত্যুর দ্বিতীয় ধাপও বলা হয়। মারা যাবার পাঁচ থেকে দশ ঘণ্টা পরে কঙ্কালের পেশীগুলো শক্ত হয়ে যায়, যাকে বলে Rigor mortis, এবং এটি তিন-চার দিন পরে শেষ হয়ে যায়। রেখে দেওয়া দেহের নীচের অংশে যে লাল-নীল রঙ দেখা যায়, তাকে বলে Livor mortis; রক্ত জমা হবার কারণে এমন হয়। মৃত্যুর খানিক বাদেই রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে। তারপরে দেহের যে পচন শুরু হয়, তার জন্য দায়ী এনজাইম ও ব্যাক্টেরিয়া। দেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিভিন্ন সময়ে মারা যায়। সোমাটিক মৃত্যুর ৫ মিনিটের মধ্যেই মস্তিষ্কের কোষগুলির মৃত্যু ঘটে। অন্যদিকে হৃৎপিণ্ডের কোষগুলি ১৫ মিনিট এবং বৃক্কের কোষগুলি প্রায় ৩০ মিনিট বেঁচে থাকতে পারে। এই কারণে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সদ্যমৃত দেহ থেকে সরিয়ে নিয়ে জীবিত ব্যক্তির দেহে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়।

সম্পর্কিত খবর