বেনজীরের বলা ‘কিসসা আভি ভি বাকি হ্যায়’ কোনদিকে মোড় নিচ্ছে ?

বেনজীর আহমেদ

বেনজীরের বলা ‘কিসসা আভি ভি বাকি হ্যায়’ কোনদিকে মোড় নিচ্ছে ?

নিজস্ব প্রতিবেদক

দুর্নীতি অভিযোগ এবং অনিয়ম করে হাজার কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়ার তথ্য প্রকাশের পর দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবার এমন গুঞ্জন কয়েকদিন থেকেই।  
একটা টিভি ইন্টারভিউতে বেনজীর ও তার স্ত্রী বিশেষ সাক্ষাতকার দেওয়ার সময় বেনজীর এমনটা বলেছিলেন, জিশানের ( স্ত্রীর নাম) পায়ের নিচে যেন দুটো চাকা। পৃথিবী ঘুরতে চায় । অবসরের পর ঘুরব।

 
কিন্তু বেনজীর এবার ঘুরতে বেরুননি। পালিয়েছেন। আবার তিনি এতো ধূর্ত যে ৬ জুন হাজির হয়ে আরেকটি নাটক সাজানও যদি সেটাও অবিশ্বাস্য নয় বলে মনে করেন অনেকে। কারণ প্রথম যখন দৈনিক কালের কন্ঠে তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে রিপোর্ট হয় তখন তিনি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন,যে কথাগুলো এমন “দুয়েকজন অনেক ক্ষিপ্ত, খুবই উত্তেজিত হয়ে এক্ষুনি সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, প্রবন্ধ লিখে ফেলছেন।
দয়া করে সামান্য ধৈর্য ধরুন। ঘোষণাই তো আছে ‘কুৎসার কিসসা আভি ভি বাকি হ্যায়’।
মানে বেনজীর নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন কিসসা বা খেলা আর বাকি আছে।  
অনেক খেলেছেন। ব্যাংক থেকে টাকা সরিয়ে নিয়েছেন। দেশের চাইতে বিদেশের আর কয়েকটি দেশগুণ অন্তত ১০ গুণ টাকা পাচার ও সম্পদ রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।  
ফলে তিনি বিদেশে পালিয়ে গেলেও অস্বাভাবিক নয়। বিভিন্ন সম্প্রচারমাধ্যমে এরিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে , তিনি সপরিবারে দুবাইয়ে আছেন। কোথাও বলা হয়েছে তিনি সিঙ্গাপুরে রয়েছেন।  
এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গত শনিবার (১জুন) দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শুধু বলেছেন, বেনজীর দোষী হলে ছাড় পাবেন না। তবে বেনজীর কোথায় আছেন জানেন না।  
পুলিশ বাহিনীর এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, সুস্পষ্টভাবে কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে তার দায় প্রতিষ্ঠান নেয় না। পুলিশ অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময়ই সোচ্চার। কেউ অন্যায় করলে ছাড় দেওয়া হবে না।  
তবে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, যথাসময়ে ৬ জুন বেনজীর উপস্থিত হয়ে সবাইকে চমকে দিতে পারেন।  অন্যদের ধারণা, না, তিনি এতোটা রিস্ক নিবেন না। তিনি ইতোমধ্যে বিদেশ চলে গেছেন।
তবে ৪ মে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে তিনি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেন বলে সূত্রটি উল্লেখ করেছে। বর্তমানে স্ত্রী জিশান মির্জার চিকিৎসার জন্য বেনজীর আহমেদ প্রথমে সিঙ্গাপুরে অবস্থান করেন , পরে দুবাই চলে যান।  
তিনি দেশে ফিরেছেন কি না তা নিশ্চিত করতে পারেনি সূত্রটি।
বেনজীর পরিবারের ঘনিষ্ঠ আরেকটি সূত্র জানায়, 'দুদকের তলবের নির্ধারিত তারিখে তিনি (বেনজীর) অবশ্যই হাজির হবেন, তবে তার স্ত্রী ও কন্যারাও দুদকের সামনে হাজির হবেন কি না তা অনিশ্চিত। '
তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মতে, বেনজীর আহমেদ তার আইনজীবী এবং উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ বজায় রাখছেন।
বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র্যা বের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময় র্যাবের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি এই বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারাও নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিলেন। যার মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামও ছিল। যুক্তরাষ্ট্র যখন নিষেধাজ্ঞা দেয়, তখন আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন বেনজীর আহমেদ।
যদিও নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ২০২২ সালের আগস্টে বেনজীর আহমেদ জাতিসংঘের পুলিশপ্রধান সম্মেলনে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যান।
তবে সম্মেলনের কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার বাইরে ওই সফরে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোথাও তিনি যেতে পারেননি।
এর আগে গত ৩১ মার্চ কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হয় ‘সাবেক আইজিপির অপকর্ম-১’। এই পর্বে ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ শিরোনামে মূল প্রতিবেদনে বলা হয়, গোপালগঞ্জে বেনজীরের পরিবারের মালিকানায় রয়েছে প্রায় ৬০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত চোখ-ধাঁধানো রিসোর্ট। তার পাশে কিনেছেন আরও ৮০০ বিঘা জমি। শুধু তা-ই নয়, রাজধানীর গুলশানে ১৭ কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় সাড়ে তিন কোটি টাকা মূল্যের ফ্ল্যাটসহ দেশে-বিদেশে বিপুল সম্পদ গড়ে তোলেন তিনি।
এরপর গত ২ এপ্রিল কালের কণ্ঠে প্রকাশিত হয় ‘সাবেক আইজিপির অপকর্ম-২’। এই পর্বের মূল শিরোনাম ছিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’। অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুরের ভাওয়াল গড় ইউনিয়নের নলজানী গ্রামে ১৬০ বিঘা জমির ওপর যে রিসোর্ট গড়ে তোলা হয়েছে, তাতে বনের জমিই রয়েছে অন্তত ২০ বিঘা। ওই রিসোর্টের ২৫ শতাংশের মালিকানা বেনজীরের পরিবারের হাতে।
কালের কণ্ঠ’র এসব প্রতিবেদন দেশে-বিদেশে আলোচনার ঝড় তোলে। পরে গত ৪ এপ্রিল দুদক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগ্যান। পরে ২১ এপ্রিল হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। একই দিন বেনজীরের অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদকে আবেদন করেন সংসদ সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।
বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি অনুসন্ধানে গত ২২ এপ্রিল তিন সদস্যের অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে দুদক। কমিটির সদস্যরা হলেন কমিশনের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক জয়নাল আবেদীন ও নিয়ামুল হাসান গাজী। ২৩ এপ্রিল হাইকোর্টের এক আদেশে দুই মাসের মধ্যে অনুসন্ধানের অগ্রগতি প্রতিবেদন হলফনামা আকারে জমা দিতে বলা হয়।
দুদকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, আগামী ৬ জুন বেনজীর ও ৯ জুন তার পরিবারের সদস্যরা দুদকে সশরীরে হাজির হয়ে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেন, নাও পারেন। আবার তারা আইনজীবীর মাধ্যমেও তাদের বক্তব্য ও তথ্য-উপাত্ত পাঠাতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তারা যেটাই করেন, ৬ জুনের পর দুদক আইনের ২৬(১) ধারা অনুযায়ী বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের আদেশ জারি করা হতে পারে।
প্রসঙ্গত, এর আগেও দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক মন্ত্রী, এমপি, সচিব, শিল্পপতিসহ ‘হাইপ্রোফাইল’ অনেককেই দুদকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে মামলা দায়েরের পর। কারণ মামলার তদন্তকালে আসামিদের বক্তব্য নেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তদন্ত সম্পন্ন করতে আসামিদের বক্তব্য নেওয়া বাধ্যতামূলক।
এসব ঘটনার পর থেকে বেনজীরের সাথে বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি অনেকটা লাপাত্তাই রয়েছেন।

news24bd.tv/ডিডি