কেমন ছিল রাসুল (সা.)-এর স্ত্রীদের শেষ জীবন

কেমন ছিল রাসুল (সা.)-এর স্ত্রীদের শেষ জীবন

 আহমাদ আরিফুল ইসলাম

রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রীদের বলা হয় উম্মাহাতুল মুমিনিন। এর অর্থ হচ্ছে ‘বিশ্বাসীদের মা’। কোরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে, ‘আর নবীর স্ত্রীবর্গ তোমাদের মাতৃতুল্য। ’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৬)

নবীজির বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন ১৩ জন মহীয়সী নারী।

তন্মধ্যে দুজন মহানবী (সা.)-এর জীবদ্দশায় প্রয়াত হন। অন্য দুজনের সঙ্গে অন্তরঙ্গতার আগেই বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বাকি ৯ জন নবীজির ওফাতের পরও জীবিত ছিলেন বহুদিন, নববী আলোর উজ্জ্বল দীপশিখা হয়ে। (সিরাতে ইবনে হিশাম : ২/৬৪৭)
কেমন কেটেছে নবীপত্নীদের নবীবিহীন সেই সময়, সে বিষয়ে আলোচনা করা হলো :

নববী আলোর বিকিরণ
শিক্ষাদীক্ষাহীন জাহেলি সমাজে পুরুষের তুলনায় নারীরা ছিল আরো পশ্চাৎপদ।

তাই তাদের মধ্যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য নারী প্রশিক্ষিকার প্রয়োজনীয়তা ছিল সর্বাধিক। পর্দা ফরজ হওয়ার পর এই প্রয়োজনীয়তা আরো বেড়ে যায়। ফলে রাসুল (সা.)-এর স্ত্রীরা তাঁর সহযোগী হয়ে এ কাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। বহু পুরুষ সাহাবিও তাঁদের কাছ থেকে হাদিস জেনে নিতেন।
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর পরও মা আয়েশা, হাফসা, উম্মে সালামা (রা.) প্রমুখের এ ব্যাপারে ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

হাদিস বর্ণনা
দীর্ঘদিন নবীজির সাহচর্যে থেকে তাঁরা ইসলামের শিক্ষাদীক্ষা লাভ করেছেন। ইসলামী সংস্কৃতিতে সংস্কৃতিমনা হয়ে উঠেছেন। অতঃপর তাঁর ওফাতের পরে তাঁরা এই অমূল্য আমানত উম্মতের কাছে পৌঁছে দিতে ব্রতী হন। উম্মুল মুমিনিন প্রায় দুই হাজার ৮২২টি হাদিস বর্ণনা করেন। যার বেশির ভাগ আয়েশা (রা.)-এর। (সীরাতুর রাসুল, পৃষ্ঠা-৭৬৮)

মাসআলা-মাসায়েল ও উদ্ভূত বিষয়ের সমাধান
নবীবিহীন নতুন মুসলিম বিশ্বে প্রায় সময় বিভিন্ন মাসআলা উদ্ভূত হতো, যার সমাধানের জন্য সাহাবায়ে কিরাম উম্মুল মুমিনিনদের কাছে শরণাপন্ন হতেন। ওমর (রা.) থেকে শুরু করে বড় বড় অনেক সাহাবি এ কাজ করতেন। নবীপত্নীরা নববী শিক্ষার আলোকে তার সমাধান দিতেন।

উম্মাহর নেতৃত্ব দান
উম্মাহর সংকটকালীন মুহূর্তে প্রয়োজনে তাঁরা নেতৃত্বও দান করতেন। এর উত্কৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে জঙ্গে জামাল। উষ্ট্রীতে চড়ে আম্মাজান আয়েশার সেই নেতৃত্বের কীর্তি গাঁথা ইতিহাস আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।

বৈবাহিক বন্ধন
পবিত্র স্ত্রীদের জন্য আল্লাহ অন্য স্বামী গ্রহণ হারাম করে দিয়েছেন। যেহেতু এটা ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবে নেতিবাচক এবং শানে নবুয়তের সঙ্গেও বেমানান—এ জন্য আল্লাহ পাক আগেই ইরশাদ করে দিয়েছেন— ‘কখনো তোমাদের এই অধিকার থাকবে না যে তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রীদের তোমরা বিবাহ করবে। এটা অবশ্যই মহান আল্লাহর কাছে বিরাট অপরাধ। ’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৫৩)

জীবিকা ও ভরণ-পোষণ
নবীরা কোনো মিরাস (উত্তরাধিকার সম্পদ) রেখে যান না, কেউ তাঁদের ওয়ারিশও হন না। আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেন, ‘আমাদের উত্তরাধিকারী হয় না। আমরা যা রেখে যাই, তার পুরোটা সদকা। ’ (বুখারি, হাদিস : ৬৭২৬ )

আয়েশা (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) এমন পরিস্থিতিতে প্রয়াত হন যে আমার ঘরে এক সা জব ছাড়া কিছুই ছিল না। ’ (বুখারি, হাদিস : ৬৭২৬)

তবে নবীজির জীবদ্দশায় তাঁদের ভরণ-পোষণের যে ব্যবস্থা ছিল, তাঁর ওফাতের পরও সেভাবেই ভরণ-পোষণসহ অন্যান্য খরচের ব্যবস্থা হতো। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি যা রেখে যাব, তা থেকে আমার স্ত্রীদের ভরণ-পোষণ এবং আমার নায়েবদের খরচ মেটানো হবে। এরপর যা অবশিষ্ট থাকবে, তা সদকাহ। (মুসলিম, হাদিস : ২৭৭৬)

বাসস্থান
রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বীয় জীবদ্দশায় প্রত্যেক স্ত্রীর জন্য পৃথক আবাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সবার জন্য পৃথক ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন। নবীজির ওফাতের পর তাঁরা সেখানেই বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘আর তোমরা তোমাদের ঘরেই অবস্থান করবে। ’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ৩৩)

ইমাম বুখারি (রহ.) বুখারিতে উক্ত আয়াতের রেফারেন্সে অনুচ্ছেদ অবতারণা করে লেখেন যে এই ঘরসমূহের নিসবত উম্মুল মুমিনিনদের দিকে করা হয়েছে। নবীজির ওফাতের আগে যেমন এই নিসবত তাদের দিকে ছিল, তেমনি পরেও ছিল। অর্থাৎ যদিও তাদের মালিকানা অর্জিত হয়নি, তবে নবীজির ওফাতের আগে যেমন তাদের উক্ত ঘরে থাকার অধিকার ছিল, তেমনি পরেও সেই অধিকার অবশিষ্ট ছিল। (ইনআমুল বারী ৭/১১৩৪)