ট্রানজিট দুই দেশের জন্য ভালো, গোটা ইউরোপেই আছে 

রহমান বর্ণিল

ট্রানজিট দুই দেশের জন্য ভালো, গোটা ইউরোপেই আছে 

রহমান বর্ণিল

বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতীয় রেল চলার চুক্তিতে দেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। সাধারণ মানুষ তো আছেই, রাজনীতিক দলগুলোও উদ্বেগ প্রকাশ করছে। অথচ দেশ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এই মুখস্থ কথাবার্তার বাইরে রিজিওনাল কানেক্টিভিটি কিংবা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনের বহুমুখী পদ্ধতি সম্পর্কে  ন্যূনতম জ্ঞান থাকলে এমন সরলীকরণ তারা করতো না। ভারতীয় রেল বাংলাদেশের করিডোর ব্যবহার করবে।

কথা সত্য। কিন্তু এই সত্যটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আপনি উদ্ঘাটন করতে পারেননি। পারবেনও না। কারণ সবকিছুতে বিরোধিতা করতেই হবে এই মর্মে আপনি বদ্ধপরিকর।
এটা আপনার সীমাবদ্ধতা। কিন্তু আগামীর অসীম বিশ্বের অপরিহার্য রিজিওনাল কানেক্টিভিটির জন্য এটা গুরুত্বপূর্ণ একটা পদক্ষেপ।  
দেশ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে বলার আগে আপনাকে ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট এবং করিডোর ব্যাপারগুলো বুঝতে হবে। বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় দেশের মধ্যে ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট চালু আছে আরো আগে থেকে। শুধু বাংলাদেশই ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে তা নয়, ভারতেও বাংলাদেশের ট্রানজিট সুবিধা আছে। সেই সুবিধায় ভারতের ভূমি ব্যবহার করে নেপাল-ভুটানে বাংলাদেশে পণ্য নিয়মিত পরিবহন হয়। বর্তমানে পাঁচটি রুটে বাংলাদেশ-ভারত ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে তিনটি যাত্রীবাহী ইন্টারচেঞ্জ, বাকি দুটি পণ্যবাহী। করিডোর পদ্ধতিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকবে ভারতের পণ্যবাহী রেল। এই রেল ভারতের গেদে থেকে বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় আসবে। সেখান থেকে পাবনার ঈশ্বরদী, নাটোরের আব্দুলপুর, দিনাজপুরের পার্বতীপুর, নীলফামারী সীমান্তবর্তী চিলাহাটী স্টেশন হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলার হলদিবাড়ী স্টেশনে যাবে। এই চুক্তিতে ভারতের অন্তত ছয়টি রাজ্যে পণ্য পরিবহনের খরচ অনেক কমে যাবে। এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্য পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের করিডোর ব্যবহারে ভারত অনেক লাভবান হবে ঠিক। কিন্তু বাংলাদেশের লাভের হিস্যাটি নেহায়েত কম তো নয়ই, উপরন্তু দীর্ঘমেয়াদে লাভ বাংলাদেশরই বেশি।
এই প্রক্রিয়ায় টোল, ফি'র মাধ্যমে বেশ রাজস্ব আদায় হবে, ভারত বাংলাদেশ বিনিয়োগ বাড়াতে বাধ্য হবে, ভারতে শুল্কমুক্ত পণ্য রপ্তানি সুবিধা, কনটেইনার ওঠানো-নামানো বাবদ মাশুল, ভারতীয় পণ্য আনা-নেওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্ত শিপিং এজেন্ট, ট্রানজিট অপারেটর এবং কনটেইনার পরিবহন বাবদ দেশীয় পরিবহন খাতেরও আয় হবে, পর্যটন, হোটেল, রেস্তোরা ব্যবসার প্রসার ঘটবে। বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা, বন্দর ও অন্যান্য অবকাঠামো খাতের উন্নয়ন হবে। এই বিশেষ সুবিধাটি ভারতকে ব্যাপকভাবে লাভবান করবে তাতে সন্দেহ নেই। তবে এই প্রক্রিয়ায় দৃশ্যমান লাভের বাইরের বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় লাভ হবে কুটনীতিক সম্পর্কে। রেল করিডর ব্যবহারে ভারত বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। ভারতের এ নির্ভরতাকে বাংলাদেশ কুটনীতিক হাতিয়ার বা বার্গেইনিং টুলস হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। ধরুন ভবিষ্যতে বাংলাদেশ ভারতকে বলল, নন টারিফ বেরিয়ার্স, সীমান্ত সমস্যা, সমুদ্রবিরোধ নিষ্পত্তি বা পানিবণ্টন চুক্তি না হলে আমরা ট্রানজিট-ট্রানশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধ করে দিবো। তখন করিডোর সুবিধা বিবেচনায় ভারত কনসিডার করতে বাধ্য হবে।
এই ট্রানজিট, ট্রানশিপমেন্ট, করিডোর দেয়া নেয়ার সম্পর্ক কেবল বাংলাদেশ ভারতের মধ্যেই নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিটি দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন রিজিওনে এক দেশের সাথে অন্যদেশের এরকম বানিজ্যিক রুট শেয়ারিংয়ের সম্পর্ক রয়েছে। এতে করে সেই সব দেশসমূহে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এক দেশ অন্য দেশের কাছে বিক্রিও হয়ে যাচ্ছে না। বরং দেশগুলো অর্থনীতিকভাবে ব্যাপক লাভবান হচ্ছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ ও ভারত দেশ দুটি একটি অন্যটির সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতে চায়। বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আমদানি করে ভারত থেকে। বিশেষত খাদ্যপণ্যের জন্য ভারত গুরুত্বপূর্ণ। আঞ্চলিক নিরাপত্তায়ও দুটি দেশের একে অপরকে প্রয়োজন। কেউ কারো বশ্য নয়, উইন উইন সিচুয়েশন না হলে কেউ কাওকে এক ইঞ্চি ছাড়ও দেয়নি, দিবে না। আপনার মস্তিষ্কে ঘিলু থাকলে আপনি ব্যাপারগুলো বুঝতে পারবেন, ঘিলুর জায়গায় গোবর থাকলে, গেলো, গেলো, দেশ ভারতে বিক্রি হয়ে গেলো বলে বেকুবের মতো জিকির করবেন।  

news24bd.tv/ডিডি