ইমামতি করে বেতন নেওয়ার বিধান

ইমামতি করে বেতন নেওয়ার বিধান

 মুফতি আতাউর রহমান

মুসলিম সমাজে ইমাম বা ইমামতি অত্যন্ত সম্মানজনক শব্দ। সাধারণত মসজিদে যিনি নামাজ পড়ান তাকে ইমাম বলা হয়। কিন্তু ইসলামী জীবনব্যবস্থায় ইমামের কর্মপরিধি অনেক বিস্তৃত। ইসলামের নির্দেশনা হলো ইমামই একটি সমাজের ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেবে।

ইসলামের ইতিহাসের শুরুভাগে ইমামতি ছিল একটি অবৈতনিক পদ। কালক্রমে মসজিদের ইমাম ও খতিবের জন্য বেতন-ভাতা নির্ধারণের প্রচলন ঘটেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মসজিদের ইমামতি করে বেতন গ্রহণ করা কি বৈধ? সে উত্তর জানার আগে ইমামের পরিভাষার অর্থ জেনে নেওয়া যাক।

ইমামের পরিচয়
ইমাম শব্দটি আরবি ‘আল-আম্মু’ থেকে এসেছে।

যার অর্থ উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য। যেহেতু ইমাম নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে মানুষের লক্ষ্যে পরিণত হন, তাই তাঁকে ইমাম বলা হয়। ইসলামী পরিভাষা ইমামত শব্দটি তিনটি অর্থে ব্যবহৃত হয়-

১. আল ইমামাতুল কুবরা (প্রধান নেতৃত্ব): ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধানকেও ইমাম বলা হয়। তখন তা খলিফা, বাদশাহ ও রাষ্ট্রপতি ইত্যাদি শব্দের সমার্থক হবে।

২. আল ইমামাতুস সুগরা (অপ্রধান নেতৃত্ব): যিনি নামাজে মুসলিম সমাজের নেতৃত্ব দেন।

৩. আলিমুন মুক্তাদা বিহি (অনুসরণীয় আলেম) : মুসলিম সমাজের এমন প্রত্যেক জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তি, যাকে মানুষ অনুসরণ করে। এখানে দ্বিতীয় শ্রেণির ইমামত বা ইমাম উদ্দেশ্য। অর্থাৎ যাঁরা মসজিদে ইমামতি করেন।

ইমামতি করে বেতন নেওয়া যাবে?

ইমামদের বেতন-ভাতা গ্রহণের দুটি দিক হতে পারে—

ক. রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন নেওয়া: ইসলামী আইনবিদরা এ বিষয়ে একমত যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে মসজিদের মুয়াজ্জিন, ইমাম, খতিবদের জন্য বেতন গ্রহণ করা বৈধ।

একইভাবে এমন ব্যক্তিবর্গ, যারা জনমানুষের সেবায় নিয়োজিত, তারাও রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা গ্রহণ করতে পারবে। এটা সম্মানী ও ভাতা হিসেবেই গণ্য হবে, তাদের কাজের বিনিময় নয়। রাষ্ট্র এটা দেবে যেন সাধারণ মানুষ তাদের নিরবচ্ছিন্ন সেবা লাভ করতে পারে।

শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) লেখেন, ‘রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে যে সম্মানী গ্রহণ করা হয় তা বিনিময় বা পারিশ্রমিক নয়, বরং সেটা জীবিকার এমন ব্যবস্থা, যা মানুষকে আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে সাহায্য করে। সুতরাং কেউ আল্লাহর জন্য কাজ করলে প্রতিদান পাবে, যদিও সে রাষ্ট্রীয় সহায়তা গ্রহণ করে। ’ (আল ইখতিয়ারাতুল ফিকহিয়্যা, পৃষ্ঠা-৪৯২)

খ. মুসল্লিদের থেকে চাঁদা তুলে বেতন দেওয়া: এ বিষয়ে ইসলামী আইনজ্ঞ আলেমদের ভেতরে মতভিন্নতা আছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগের আলেমরা একান্ত প্রয়োজন ছাড়া আজান দিয়ে ও ইমামতি করে অর্থ গ্রহণ করাকে বৈধ মনে করতেন না। কেননা উসমান ইবনে আবিল আস (রা.) বলেন, ‘আমার প্রতি রাসুলুল্লাহ (সা.) শেষ যে অঙ্গীকার নিয়েছিলেন তা হলো আমি যেন এমন ব্যক্তিকে মুয়াজ্জিন নিযুক্ত করি যে আজান দিয়ে বিনিময় গ্রহণ করবে না। ’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২০৯)

তবে বর্তমান যুগের ফকিহ ও ইসলামী আইন গবেষকদের মত হলো, আজান দিয়ে ও ইমামতি করে বিনিময় গ্রহণ করা জায়েজ। কেননা মানুষের ব্যস্ততা ও জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে যাওয়ায় বর্তমান যুগে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম, যারা নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আজান দেবে ও ইমামতি করবে। এ ছাড়া এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তাদের সাহায্য-সহযোগিতাও করা হয় না। ফলে জীবনধারণের মতো প্রয়োজনীয় বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা না হলে মসজিদগুলো বিরান হয়ে যাওয়ার ভয় আছে।

আর বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয় ব্যক্তি এই পেশায় নিজেকে ব্যস্ত রাখার বিনিময়ে; বরং ইসলামী আইনজ্ঞদের মত হলো, ইমাম-মুয়াজ্জিনদের বেতন-ভাতা সম্মানজনক হওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তারা সমাজে দ্বিনের প্রতিনিধিত্ব করে। তাই তাদের জীবনধারা উন্নত হলে মানুষ ধর্ম ও ধর্মীয় জ্ঞানচর্চায় উত্সাহী হবে এবং দ্বিনের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। (আহকামুল ইমামি ওয়াল ইতিমামি, পৃষ্ঠা-৭৬)

আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন।  
 

এই রকম আরও টপিক