পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার (এক): প্রেক্ষাপটের প্রথম পর্ব 

অলংকরণ, সাদিয়া মুমু

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার (এক): প্রেক্ষাপটের প্রথম পর্ব 

অনলাইন ডেস্ক

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পতন ঘটে হাসিনা সরকারের। গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন তিনি। বর্তমানে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনা করছে। চলছে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ।

ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে সবচাইতে বেশি সামনে এসেছে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্ন। রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে এর প্রধান প্রধান যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে তা সংস্কার দরকার। আর এ কাতারে প্রথম দিকেই পড়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংস্কারের প্রশ্ন।

এখন থেকে ১৭ বছর আগে ২০০৭ সালে ১/১১ হিসেবে কথিত কুখ্যাত জরুরি আইন লঙ্ঘন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে "মানুষ নেটওয়ার্ক"-এর পক্ষ থেকে "পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার প্রসঙ্গ শিক্ষক ও ছাত্র-রাজনীতি" নামে সেলিম রেজা নিউটন তিন ঘণ্টার একটি বক্তৃতা উপস্থাপন করেছিলেন।

পরে সেটি "যোগাযোগ" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

বর্তমানে ২০২৪-এর চলমান ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে মূলত সেই আলোচনাটিই ভিডিও আকারে নতুন করে রেকর্ড করে পোস্ট করা হচ্ছে। সে আলোচনা তুলে ধরা হলো-

বাংলাদেশ একটা ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন একটা পর্যায়ে এসে দাড়িয়েছে। গত ১৫ জুলাই থেকে শুরু করে ৩৬ শে জুলাই পর্যন্ত (৫ আগস্ট) এর মধ্যে বাংলাদেশে একটি বিরাট ছাত্র গণঅভ্যুত্থান হয়ে গিয়েছে। এবং এই ছাত্র গণঅভ্যুত্থান যে প্রশ্নে হয়েছে সে প্রশ্নটা সবার চাইতে বেশি করে সামনে এনেছে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্ন।

রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নটা বিমূর্ত কোনো প্রশ্ন না। রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্ন যেমন কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে চলবে, ক্ষমতার কাঠামোগুলো কিভাবে নতুন যুগে এসে কাজ করবে, আজকের যুগে সেগুলো নির্ধারণ করা আবার অন্যদিকে রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে সে প্রতিষ্ঠানগুলোরও সংস্কারের প্রশ্ন। তারই মধ্যে আসে দেশের পাব্লিক, প্রাইভেট এবং সব রকম বিশ্ববিদ্যালয়নগুলো সংস্কারের প্রশ্ন।  

আমরা পেশাজীবিরা যখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করি , আমরা সেই প্রতিষ্ঠানটার আইনি এবং পরিচালনাগত কাঠামো নিয়ে তেমন ভাবি না। আমরা আমাদের মুখস্ত অভ্যাসে, চাকরি করার অভ্যাসে যেভাবে যেভাবে আমাদেরকে বলা হয়, যেভাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠানটা অনেকদিন ধরে চলে আসছে সেখানে গা ভাসিয়ে ধামা ধরে কাজ করে যাই মুখ বুজে। কিন্তু এমন এমন পরিস্থিতি আসে যখন এমন এমন ঘটনা ঘটে তখন আমাদেরকে অন্তত কাউকে না কাউকে ভাবতে হয় যে এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পদ্ধতি কি ঠিক আছে? এই প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগত ব্যাপারগুলো কি ঠিক আছে? তখন আমাদেরকে অন্তত কোনো কোনো মানুষকে সক্রিয়ভাবে ভাবতে হয় যে আরো ভালোভাবে কেমন করে প্রতিষ্ঠানটা চলতে পারে।  

বাংলাদেশে এই মুহুর্তে একটি ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের বৈপ্লবিক আহ্বানে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্ন বিপুলভাবে বিবেচিত হচ্ছে এবং সংস্কারের কাজ তুমুল গতিতে শুরু হয়েছে। যে শিক্ষার্থীরা এই ছাত্র গণবিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়েছে তারা সহ অন্যরা নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ গ্রহণ করেছেন এবং তাদের কাজ শুরু করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমার মনে হয়েছে যে আমাদের দিক থেকে এখনই পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংস্কারের প্রশ্নটাকে সামনে নিয়ে আসা।

পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংস্কারের প্রশ্নটাকে মোটের উপর আমরা যদি সামনে আনতে পারি, তাহলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারের দিকগুলোও আরও অন্যরা তুলে ধরবেন নিশ্চয়ই। এবং আমাদের এখনকার এই আলোচনা থেকেও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়- প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, বা যে বিশ্ববিদ্যালয় গুলো ৭৩ এর আইনের অধীনে সরাসরি না সে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংস্কারের বাপ্যারেও আমরা বেশ খানিকটা আভাস পাব।

বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালে রচিত একটা আইন যেটা ৭৩ এর আইন বলে আমরা সাধারণভাবে বলি। এই ৭৩ এর আইনের অধীনে বাংলাদেশের চারটা প্রধান বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়, আদি চারটা প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এই পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত দিকগুলো নিয়ে তিনবার বড় করে প্রশ্ন উঠেছে আমাদের দেশের ইতিহাসে।

একবার মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমরা কি ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় চাই সে প্রশ্ন সামনে এসেছিল। এবং সেই প্রশ্নকে সামনে রেখেই তৎকালীন পার্লামেন্ট নারায়ণ মোহনের সাথে কথাবার্তা বলে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথেও কথাবার্তা বলে ১৯৭৩ সালের আইন রচনা করা হয়। আমাদের আদি চারটা পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয় যাদের নাম বললাম, এই পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বলতে গেলে একই আইন দিয়ে চলে।  যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আইন এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আইন নাম নিয়ে চারটা আলাদা আলাদা আইন আছে । চারটা আইনই একই আইনের সামান্য এদিক-সেদিক করা রূপ। পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনগুলোর মধ্য দিয়ে আমরা আজকে যে পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখছি তার ছবি আঁকা হয়েছিল, আদি কাঠামোগত ছবিটা। এবং আমরা ওই আইনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিভাবে চলবে তার একটা পূর্নাংগ রুপরেখা পেয়েছিলাম।  আজকে আমরা যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখছি , তারা যেভাবে চলছে, তার ভালো এবং মন্দ, সমস্ত কিছুর গোড়া নিহিত আছে এই ৭৩ এর আইনের মধ্যে।

তারপরে ২০০৬ এবং ২০০৭ সালে যখন ১/১১ গভর্মেন্ট ক্ষমতা নেয়, সেনা সমর্থিত সরকার মূলত সামরিক সরকারই বলবো আমি। সেই সামরিক সরকারের অধীনে সামরিক এবং বেসামরিক আমলারা হঠাৎ করে উঠে পড়ে লেগেছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য। এবং তারই মধ্যে তারা অচিরেই পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলো সংস্কারের কথা তোলেন জোরেশোরে এবং তারা একটা আম্ব্রেলা অ্যাক্ট  লিখে ফেলেন। সেই আম্ব্রেলা অ্যাক্টের অধীনে তারা চেয়েছিলেন সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় ওই একটা আইনের অধীনে আসবে।

তৃতীয়বার, আমরা এখন এই ছাত্র গণ অভ্যুত্থানের ভিতর দিয়ে যে পরিস্থিতিতে এসে হাজির হয়েছি সেখানে রাষ্ট্র সংস্কারের সত্যিকারের বৈপ্লবিক প্রশ্ন এসেছে এবং সেই প্রশ্নের সাড়া দেওয়ার জন্য আমাদের দিক থেকেও কথা বলার প্রয়োজন পড়েছে, আমরা কি ধরণের সংস্কার চাই। আমি শিক্ষক সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে এখানে কথা বলছি না, আমি এখানে পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০ বছর ধরে চাকুরিরত একজন শিক্ষক হিসেবে আমার ব্যক্তিগত মতামত তুলে ধরছি। এই মতামতগুলো আমার ধারণা, আমার বিশ্বাস আমার অনেক সহকর্মীর সঙ্গেই মিলবে এবং যাদের সঙ্গে মিলবে না তারাও নিশ্চয়ই তাদের মত করে কথা বলবেন। একা একা কেউ কেউ বলবেন, অনেকে মিলেও কেউ কেউ বলবেন। ইতমধ্যে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেটওয়ার্ক তাদের মত করে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে তারা কিধরণের সংস্কারগুলো চান সেগুলো তুলে ধরছেন এবং হয়তো তারা এরপরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কারের প্রশ্নে কিধরনের সংস্কার চান সেগুলোও তুলে ধরবেন।

এই তিনটা গেল আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের ৩ তা ঐতিহাসিক মুহুর্ত, যখন পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংস্কারের প্রশ্ন উঠেছে এবং আমাদেরকে ভাবতে হয়েছে যে আমরা কিধরণের পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয় চাই। ১৯৭৩ সালে একবার, ২০০৬-০৭ সালে একবার এবং এই ২০২৪ সালে একবার।  


সেলিম রেজা নিউটন : শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
  
চলবে....

শোনা থেকে লেখা : সাদিয়া মুমু

news24bd.tv/এসএম