আয়া থেকে কোটিপতি ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তারাণী

সংগৃহীত ছবি

আয়া থেকে কোটিপতি ঠাকুরগাঁওয়ের মুক্তারাণী

ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি

স্বামী মারা যাওয়ার পরে দিগ্বিদিক্ হয়ে পড়েন মুক্তা রানী। চাচাতো ভাই দুলালের মাধ্যমে আয়া পদে চাকরী শুরু করেন সিভিল সার্জন অফিসে।  চাকুরিতে থাকা অবস্থায় সংখ্যতা গড়ে ওঠে সাবেক পানিসম্পদ মন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য রমেশ চন্দ্র সেনের সঙ্গে।  তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি মুক্তা রানীকে।

কয়েক বছর আগেও যার নুন আন্তে পান্তা ফুরিয়ে যেত সেই মুক্তা এখন শত কোটি টাকার মালিক!

চার বছর চাকরি করে ছেড়ে দেন আয়ার চাকরি। তারপর মুক্তা রায় থেকে হয়ে ওঠেন মন্ত্রীর ২য় বউ খ্যাত মুক্তা সেন।  এরপরেই শুরু হয় মুক্তা সেনের কোটিপতি হওয়ার উত্থান।

ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের চণ্ডিপুর গ্রামের বাসিন্দা মুক্তা সেন।

কোর্টে মুহুরি হিসেবে কর্মরত ছিলেন তার স্বামী।  যা আয় হত তা দিয়ে সংসারে সবসময় ছিল টানাপোড়েন। স্বামী মারা যাওয়ার পরে দুই সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আয়া পদে চাকরি নিয়েছিলেন তিনি। পরে আয়া পদ থেকে চাকরি ছেড়ে নজর দেন ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে হাসপাতালের কেনাকাটা, খাবার, মাস্টার-রোলে নিয়োগ বাণিজ্য করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া শুরু করেন।  তারপর থেকে হাসপাতালের সব নিয়ন্ত্রণ নিয়ে হয়ে ওঠেন হাসপাতালের ‘রাণী’ মুক্তা সেন।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ঢাকায় দুটি ফ্ল্যাট, কার রেন্ট সেন্টারের শো-রুম, ঠাকুরগাঁও পৌরশহরের ইসলামবাগে দুই তলা বাড়ি, শান্তিনগরে দুই জায়গায় প্লট আকারে ৫ শতক করে জমি, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলএসডি গোডাউনের পাশে ১০ শতক জমি, পঞ্চগড়-ঠাকুরগাঁও মহাসড়কের পাশে রেস্টুরেন্ট।

সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের বাদুপাড়ায় বাড়ি- জমি ও সয়াবিন তেলের কারখানা, চন্ডিপুরে জমি সহ বাড়ি। ২ কোটি ৮ লাখ টাকায় মিল-চাতাল ও পুকুর কেনার জন্য দিয়েছেন ৩০ লাখ টাকা অগ্রীম। আবাদি জমি রয়েছে প্রায় ২০ বিঘা। সদরের গড়েয়া বাসস্ট্যান্ডে ৮ শতক জমির উপরে বাড়ি।

এ ছাড়াও নিয়োগ বাণিজ্য, জমি দখলসহ নামে-বেনামে সম্পত্তি ও বড় বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডার রয়েছেন। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের নওগাঁর অটো রাইস মিল কয়েক কোটি টাকায় কিনেছেন এই মুক্তা সেন।

চলতি বছরে মুক্তা সেনের দুই ছেলে তূর্য ও মাধুর্য এন্টারপ্রাইজ নামে পূবালী ব্যাংক হিসাব নম্বরে লেনদেন হয়েছে ২০ কোটি ৩৮ লাখ ২০৯৯ টাকা। সাবেক মন্ত্রী ও এমপি রমেশ চন্দ্র সেন আটক হওয়ার পর দিন সব টাকা তুলে নিয়ে বর্তমানে রয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৪১৭ টাকা। এ ছাড়াও জনতা, অগ্রণী ও সোনালী ব্যাংকেও তাদের হিসাব নম্বরে দু’বছরে লেনদেন রয়েছে প্রায় ৫০ কোটি টাকা।

শুধু নিজের আখের গুছিয়ে ক্ষান্ত হননি এই মুক্তা সেন।  ভাইদের রাজনীতিতে যুক্ত করে ঠিকাদারি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে দিয়েছেন। আর ভাতিজা-ভাতিজিদের সরকারি চাকরিও নিয়ে দিয়েছেন এই মুক্তা সেন।

হত্যা মামলায় ভারতে পলাতক থাকা বড় ভাই নারায়ণ ঠাকুরকে এনে যুক্ত করান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে।  মন্ত্রীর প্রভাব আর রাজনৈতিক দাপটে তারা হয়ে ওঠেন আরো প্রতাপশালী। তার খালাতো ভাই দুলালকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, খালাতো বোনের ছেলে নিপুণকে হাসপাতালের ঠিকাদারি, বোনের মেয়ে মৌ’কে স্কুলের শিক্ষিকা, আরেক বোনের ছেলে জয়কে ফোর্সসহ রাজস্ব ও মাস্টার রোলে জেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চাকরি দিয়েছেন তার দুই শতাধিক আত্মীয় স্বজনকে।

সাবেক মন্ত্রী রমেশ চন্দ্র সেনের ভগ্নিপতি জানান, মুক্তার আর্থিক অবস্থা আগে খারাপ ছিল।  এখন ভালো হয়েছে। বাড়ির পাশে কয়েকটা মন্দির করেছে। অসহায় মানুষদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে।  তার জমি জায়গা ও বাড়ি গাড়ি হয়েছে, তবে কারো ক্ষতি করেনি।

মুক্তা রানীর এক খালাতো ভাই ফণি রায় বলেন, সবাই আমাকে বলে মন্ত্রী নাকি আমার ভগ্নিপতি। আমি বলি, বিয়ে তো খেলাম না! তবে মুক্তার পারিবারিক অবস্থা খারাপ ছিল।  শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতো।  পরে নিজে বাড়ি কিনেছে। আমাদের আত্মীয় স্বজনের চাকরি নিয়ে দিয়েছে।  এলাকায় কিছু জমি কিনেছে।

মুক্তা রানীর বাড়ির পাশের আরেক বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা সবাই তাকে এমপির ২য় বউ হিসেবে চিনতাম।  এলাকায় জমি, তার ভাই ও বোনদের সেই সাথে আত্মীয় স্বজনদের চাকরি দিয়েছেন।  তাদের বংশের সবার চাকরি হয়েছে। এলাকার স্কুল গুলোতে অনেককে চাকরি দিয়েছে। তার বিনিময়ে টাকা নিয়েছে আবার কারো কাছে জমি নিয়েছে।  পাশেই মিল চাতাল পুকুর ২ কোটি ৮ লাখ টাকায় কেনার জন্য ৩০ লাখ গত মাসে অগ্রিম দিয়েছে।

ঠাকুরগাঁওয়ের সিভিল সার্জন ডা নুর নেওয়াজ আহমেদ বলেন, ২০১০ সালে মুক্তা রায় আয়া পদে যোগদান করেন।  পরে ২০১৪ সালে তিনি সেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দেন।

এ বিষয়ে মুক্তারানী বলেন, রমেশ চন্দ্র সেনের সাথে একটা ভাল সম্পর্ক ছিল সেটা সত্যি। রমেশ চন্দ্র সেন কি আপনার স্বামী, এমন প্রশ্ন করলে তিনি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, আমি ব্যবসা বাণিজ্য করে টাকা উপার্জন করেছি। সরকারি কর প্রদান করি প্রতিবছরই। আমার বিরুদ্ধে যেসকল অভিযোগ রয়েছে তা সত্য না।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ঠাকুরগাঁও সমন্বিত কার্যালয়ের উপ-পরিচালক তাহসীন মুনাবীল হক বলেন, আয় বহির্ভূত সম্পদ উপার্জনের কোন সুযোগ নেই।  কেউ এসবে জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  তার বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। লিখিত অভিযোগ করলে ছাড় দেওয়ার সুযোগ নেই।

news24bd.tv/JP