ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে কী করবেন?

ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে কী করবেন?

অনলাইন ডেস্ক

গত ২০০০ সালে দেশে প্রথম বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। সেই সময়ে আক্রান্ত প্রায় সবারই সেটা ছিলো প্রথম ডেঙ্গু জ্বর। যা প্রাইমারি ইনফেকশন বা প্রাথমিক সংক্রমণ হিসেবে পরিচিত। আক্রান্তদের মধ্যে তখন দ্রুত উচ্চ মাত্রার জ্বর, গায়ে তীব্র ব্যথা, চোখে ব্যথা, ফুসকুড়িসহ নির্দিষ্ট কিছু উপসর্গ দেখা যেত।

জটিলতাও হতো কম।

যদিও বর্তমানে ডেঙ্গু রোগীর বেশির ভাগই সেকেন্ডারি রোগী, অর্থাৎ তাদের সবাই আগে এক বা একাধিকবার ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। দ্বিতীয় পর্যায়ের আক্রান্তদের উপসর্গগুলো যেমন কিছুটা ভিন্ন, তেমনি রোগের জটিলতা ও মৃত্যুঝুঁকিও বেশি।

হালকা, মাঝারি বা তীব্র জ্বর, সঙ্গে অরুচি, বমি ভাব বা বমি, বিশেষ করে পাতলা পায়খানা এ সময়ের ডেঙ্গু রোগীদের বেশি দেখা যায়।

প্রকারভেদে এখন ডেঙ্গু জ্বর তিন ধরনের হয়ে থাকে। গ্রুপ–এ–তে কোনো জটিলতা থাকে না। গ্রুপ–বি রোগীদের ‘ওয়ার্নিং সাইন’ অর্থাৎ বিপৎসংকেত থাকতে পারে অথবা এদের আগে থেকেই হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, কিডনি বা লিভারজনিত ক্রনিক রোগ ছিল বা এরা উচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ, যেমন স্থূলকায়, গর্ভবতী, শিশু বা বয়স্ক রোগী। আর গ্রুপ–সি হচ্ছে তীব্র জটিল রোগী, যেমন বুকে বা পেটে পানি, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট বা রক্তচাপ কমে যাওয়া, তীব্র রক্তক্ষরণের কারণে রক্তচাপ কমে যাওয়া অথবা নির্দিষ্ট একটা অঙ্গ বিকল, যেমন লিভার ফেইলিউর, ব্রেন এনকেফালাইটিস, কিডনি ফেইলিউর নিয়ে আসতে পারে।

গ্রুপ–বি রোগীদের ওয়ার্নিং সাইন বা বিপৎসংকেত আছে কি না, খুঁজে বের করাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ওয়ার্নিং সাইনগুলো হচ্ছে জ্বরের সঙ্গে পেটে তীব্র ব্যথা, দিনে তিনবারের অধিক বমি বা পাতলা পায়খানা, শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হওয়া বা ত্বকের রক্তক্ষরণজনিত লক্ষণ, শ্বাসকষ্ট, শরীর অস্বাভাবিক ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়া, বুকে বা পেটে পানি আসা এবং বিশেষ করে জ্বর কমার সময় রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়া। এ ধরনের রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিলে জটিলতা ও মৃত্যুঝুঁকি-দুটিই অনেকাংশে কমানো যায়।

আর গ্রুপ-সি রোগীদের ক্ষেত্রে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে আইসিইউ বা এইচডিইউতে রেখে চিকিৎসা দিলে মৃত্যুঝুঁকি কমানো সম্ভব।

রক্তচাপ ‘ভালো’ মানেই সব সময় ‘ভালো’ না

সাধারণভাবে একজনের রক্তচাপ যেমন থাকে, ডেঙ্গু জ্বরে তার চেয়ে কমে যেতে পারে। এর প্রধান কারণ মূলত প্লাজমা লিকেজ (রক্তনালি থেকে জলীয় অংশ বের হয়ে যাওয়া), যা সেকেন্ডারি ডেঙ্গুতে দেখা যায়। ধরা যাক, একজনের রক্তচাপ সাধারণ অবস্থায় থাকে ১৪০/৯০ মিমি মার্কারি। কিন্তু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর রক্তচাপ হয়ে গেল ১২০/৮০ মিমি মার্কারি। যদিও হিসাবমতো এই রক্তচাপ একজন মানুষের জন্য ‘স্বাভাবিক’। কিন্তু সেই মুহূর্তে এই রক্তচাপই তাঁর জন্য কম।
আবার ধরা যাক, সাধারণ অবস্থায় কারও রক্তচাপ থাকে ১১০/৮০ মিমি মার্কারি। কিন্তু ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর তাঁর রক্তচাপ হলো ১১০/৯০ মিমি মার্কারি। আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে রক্তচাপ বেড়েছে, রোগী ভালো আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে অন্য একটি হিসাব। সেটি হলো ‘পালস প্রেশার’। অর্থাৎ ডায়াস্টোলিক আর সিস্টোলিক রক্তচাপের পার্থক্য। সহজভাবে বলতে গেলে রক্তচাপ হিসেবে যে সংখ্যা দুটি আপনি দেখছেন, সেই দুটির বিয়োগফল। এই বিয়োগফল যদি ২০ বা এর কম হয়, তার অর্থ কিন্তু পালস প্রেশার কমে যাওয়া। তাই এই রক্তচাপকেও ‘ভালো’ ধরে নেওয়া যাবে না। বরং ডেঙ্গু জ্বরের রোগী বাড়িতে থাকলেও ২০ বা এর চেয়ে কম পালস প্রেশার পাওয়া গেলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

পরীক্ষার রিপোর্ট ভালো মানেই কি নিশ্চিন্ত?

ডেঙ্গু নির্ণয়ের জন্য যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও সেগুলো অনেক সময় ‘নেগেটিভ’ আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোন পরীক্ষাটি কোন সময় করা হচ্ছে, তা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আবার সঠিক সময়ে সঠিক পরীক্ষাটি করা হলেও শতভাগ ক্ষেত্রে রিপোর্ট ‘পজিটিভ’ না-ও হতে পারে। বিশেষত ‘সেকেন্ডারি’ ডেঙ্গু জ্বরে রিপোর্ট অনেক ক্ষেত্রে ‘নেগেটিভ’ আসতে পারে। তাই রোগীর শারীরিক পরীক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যা থেকে একজন চিকিৎসক ধারণা করতে পারেন, রোগী ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত কি না অথবা জটিলতা দেখা দিয়েছে কি না।

প্লাটিলেট কমে যাওয়াই কি ক্ষতির কারণ

ভাইরাসজনিত যেকোনো জ্বরেই রক্তের প্লাটিলেট কমে যেতে পারে। অর্থাৎ এক লাখ থেকে দেড় লাখের মধ্যে হতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরেও প্লাটিলেট কমতে দেখা যায়। সেটা রক্তক্ষরণজনিত ডেঙ্গুতে এক লাখের নিচে নামতে পারে। কিন্তু এটিই রোগীর ভালো–মন্দের একমাত্র নির্দেশক নয়। বিপজ্জনকভাবে কমে না যাওয়া অবধি আসলে প্লাটিলেটের এই কমে যাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণই নেই। বরং একজন চিকিৎসক লক্ষ করেন, হেমাটোক্রিট ঠিক আছে কি না। ১০ শতাংশের বেশি হেমাটোক্রিট বেড়ে যাওয়াই নির্দেশ করে জটিলতার সূচনা। অর্থাৎ প্লাজমা লিকেজ শুরু হয়েছে। রক্তের শ্বেতকণিকার মাত্রা কমে যাওয়া কিংবা অ্যালবুমিন কমে যাওয়াও জটিলতার নির্দেশক। বুকের এক্স–রের মাধ্যমে ফুসফুসের পর্দায় পানির উপস্থিতি নির্ণয় করা যায়। পেটের আলট্রাসনোগ্রামে দেখা যায় পেটের পানি। এ রকম অস্বাভাবিক পানি জমা মারাত্মক জটিলতার নির্দেশক।

জটিলতা এড়াতে করণীয়

সাধারণভাবে হালকা জ্বরকে একটি সাদামাটা উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও এই ধারণা বদলে ফেলার সময় এসেছে এখন। বর্ষা বা বর্ষা–পরবর্তী মৌসুমে যখন এডিস মশার উপদ্রব বেশি, ডেঙ্গু জ্বরের যেকোনো উপসর্গ দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সেটিও একেবারে প্রথম দিনেই। জ্বরের প্রথম দিনেই এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করতে দেওয়া হয় এখন। সঙ্গে একটি সিবিসি। ডেঙ্গুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হলে তা নির্ণয়যোগ্য অবস্থায় আসতে বেশ কয়েক দিন সময় লাগে। মোটামুটি সাত দিন। কোন সময়ে কোন ধরনের অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা হলে তা কী নির্দেশ করে, এটিও কিন্তু কেবল ‘পজিটিভ’ বা ‘নেগেটিভ’ দিয়ে বোঝা যায় না। ডেঙ্গু জ্বরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

জ্বরের প্রথম তিন-পাঁচ দিনের মধ্যে সিবিসি ও এনএসওয়ান অ্যান্টিজেন এবং সাত দিন পর ডেঙ্গু আইজি-এম ও আইজি-জি অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা উচিত। রোগীর নাড়ির গতি ও অন্যান্য শারীরিক পরীক্ষা এবং রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টের ভিত্তিতে চিকিৎসক আপনাকে নির্দেশনা দেবেন, আপনার চিকিৎসা বাড়িতে করা যাবে, নাকি হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। শারীরিক পরীক্ষার ভেতর ‘টরনিকুয়েট টেস্ট’ নামে এমন একটি পরীক্ষাও রয়েছে, যা ‘পজিটিভ’ হলে ডেঙ্গু জ্বর ধরে নেওয়াই যায়। এটি জ্বরের প্রথম দিকে করা হয়। রক্তচাপ মাপার কাফ বেঁধে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেটির চাপ তুলে রেখে এই পরীক্ষা করা হয়। এ ছাড়া এক্স–রে বা আলট্রাসনোগ্রামের মতো কোনো পরীক্ষা করাতে হবে কি না, সেটিও জানিয়ে দেবেন চিকিৎসক। মনে রাখতে হবে, পরিস্থিতি জটিল হয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসা শুরু করা হলে তা থেকে বেরিয়ে আসাটা কঠিন হয়ে পড়ে। তাতে রোগীর শারীরিক কষ্ট বেশি হয়, মৃত্যুঝুঁকিও বাড়ে। বরং যখন পরিস্থিতি স্থিতিশীল, কিন্তু পরীক্ষা-নিরীক্ষায় জটিলতার ইঙ্গিত পাচ্ছেন চিকিৎসক, সেই সময়টা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ই শুরু করতে হয় নির্দিষ্ট চিকিৎসা, যা এই সময়ে দেওয়া হলেই সবচেয়ে বেশি কার্যকর হয়। সময়ের কাজটা সময়ে শুরু করতে পারলে এড়ানো যায় অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা।

যাদের চিকিৎসা বাড়িতেই সম্ভব

প্রত্যেক রোগীকেই একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। নির্দেশনামাফিক রক্তচাপ মাপাতে হবে, নির্দিষ্ট সময় পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে। তাহলে জটিলতার দিকে যেতে থাকামাত্রই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে। এ ছাড়া জ্বরের সাধারণ চিকিৎসা তো চলবেই। অল্প গরম পানিতে শরীর মুছিয়ে দেওয়া বা গোসল করা যেতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরের রোগীকে অবশ্যই প্রচুর তরল খাবার খেতে হবে। বিশেষ করে পুষ্টি ও লবণসমৃদ্ধ তরল, যেমন খাওয়ার স্যালাইন, ডাব, ফলের রস, শরবত, ভাতের মাড় ইত্যাদি। প্যারাসিটামল সেবন করা যেতে পারে। কিন্তু অ্যাসপিরিন বা ব্যথানাশক সেবন করা যাবে না। রোগী যদি আগে থেকেই অ্যাসপিরিন বা এমন কোনো ওষুধ সেবন করে থাকেন, যা রক্ত পাতলা করে, তাহলে চিকিৎসককে জানিয়ে রাখুন। এটি বন্ধ রাখা এবং পুনরায় শুরু করার ব্যাপারে তিনি প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন। যেসব রোগীর চিকিৎসা বাড়িতে করানো সম্ভব, সেসব রোগী ও তাঁদের স্বজনদের কিন্তু কিছু বিপদচিহ্নও চিনে রাখতে হবে।

ডা. এইচ এম নাজমুল আহসান, সহযোগী অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, ঢাকা।

news24bd.tv/SC

এই রকম আরও টপিক