রাস্তা নেই, আছে সেতু

ব্রিজের দুই ধারে রাস্তা নেই।

রাস্তা নেই, আছে সেতু

নাসিম উদ্দীন নাসিম, নাটোর প্রতিনিধি

দুই পাশে সড়ক নেই; কিন্তু আছে সেতু। বাড়ির উঠোনে, জমির মাঝখানে বা বিলের ভেতরেই বানানো হয়েছে সেতু। নাটোর জেলার ১১টি ইউনিয়নে তৈরি করা হয়েছে এরকম ১২টি অপ্রয়োজনীয় সেতু। যা দেখে অবাক এলাকাবাসীও, জানেন না, কেন কী প্রয়োজনে এসব সেতু নির্মাণ করা হয়েছে? ব্রিজগুলোর সংযোগ সড়ক (অ্যাপ্রোচ রোড) তৈরি না করায় দুর্ভোগ কমার বদলে বেড়ে গেছে দ্বিগুণ ভাবে।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে নির্মিত এসব ব্রিজের সংযোগ সড়ক না করেই টাকা তুলে নিয়েছেন বেশিরভাগ ঠিকাদার। আর ঠিকাদারদের এসব অনৈতিক কাজে সহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে খোদ প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

অভিযোগ রয়েছে, যেখানে সেখানে অপ্রয়োজনীয় ব্রিজ নির্মাণ, নদীর গতিপথ বন্ধ এবং সংকুচিত করে নির্মাণ করা হয়েছে ব্রিজগুলো। আর নির্মাণের নামে আত্মসাত করা হয়েছে কোটি কোটি টাকা।

এসব ব্রিজ সাধারণের চলাচলের অনুপযোগী হওয়ায় তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে সাধারণ মানুষের মাঝে। দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের অর্থায়নে নির্মাণ করা এসব সেতুর অন্তরালে আছে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ।

news24bd.tv

নাটোরের ছাতনি ইউনিয়নের মরে যাওয়া খালের উপর করা হয়েছে ৫০ ফিট দীর্ঘ এই ব্রিজ। দুবছর আগে ৩৯ লাখ টাকা ব্যায়ে নির্মাণ করা হয় এই অদ্ভুত ব্রিজ। কতৃপক্ষ ব্রিজ করেই খালাস। এরপর দুই পাশে সংযোগ সড়কের মাটিটুকুও জুড়ে দিয়েছেন এলাকাবাসী। যদিও তারা জানেন না; যে ব্রিজ তাদের কোনো কাজে আসবে বা কেন সেটি নির্মাণ করা হয়েছে।

নাটোরের ছাতনি ইউনিয়নে এমন পাঁচটি ব্রিজ করা হয় ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে।

স্থানীয়রা বলছেন, এই খালের তিন কিলোমিটারের মধ্যে নতুন পুরাতন মিলিয়ে ব্রিজ আছে মোট ১৩টি। যার বেশির ভাগই এমন অপ্রয়োজনীয়। ব্রিজ উঠেছে নাটোরের বিপ্রবেলঘড়িয়া ইউনিয়নের মির্জাপুর দিঘির উপর। ব্রিজ হয়েছে কোনো সড়ক বা বসতি নেই এমন স্থানেও। তেলকুপি পাঁচআনি পাড়ার এই সেতুর নামফলকে লেখা আছে ৬০ ফুট দৈর্ঘ্য। দরপত্রে বরাদ্দ হয়েছে সেভাবেই। কিন্তু সরেজমিন মেপে দেখা যায়, নির্ধারিত দৈর্ঘ্যর চেয়ে ছোট সেতুটি। ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে নাটোরের ১১টি ইউনিয়নে এমন ব্রিজ হয়েছে ৪৫টি। যাতে ব্যায় হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা।

সরেজমিনে নাটোর ও নলডাঙ্গা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নাটোর সদর উপজেলার তেলকুপি জলার ওপর সেতু নির্মাণ করে নাটোর সদর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ। ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যর ব্রিজটি নির্মাণে ব্যায় ধরা হয় ৩২ লাখ ৫২ হাজার টাকা। আর নির্মাণের জন্য কাজটি পায় ছাত্রলীগের এক নেতা। কিন্তু ২০১৬-১৭ অর্থবছর শেষ হয়ে গেলেও আজও পূর্ণঙ্গভাবে ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়নি। অথচ নির্মাণের পুরো টাকা পকেটে ভরেছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে ব্রিজটি দুই পাড়ে সংযোগ সড়ক না থাকায় যাতায়াত করতে পারছে না এলাকার জনসাধারণ। ফলে নতুন অবস্থায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে রয়েছে ব্রিজটি।

অপরদিকে, কিছু দূরেই ছাতনি দিয়ার দক্ষিণপাড়া মসজিদের নিকট ৪০ ফুট দৈর্ঘের অপর একটি ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। ওই ব্রিজটিরও নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩২লাখ ৫২ হাজার টাকা। মসজিদের মুসল্লিদের যাতায়াতের জন্য ব্রিজটি নির্মাণ করা হলেও আজও তৈরি করা হয়নি সংযোগ সড়ক। ফলে বাধ্য হয়ে বাশের সাঁকো তৈরি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ব্রিজটি দিয়ে পারাপার হচ্ছে মুসল্লিরা। তবে সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য অর্থ বরাদ্দ থাকলেও কাজ না করেই ব্রিজ নির্মাণের পুরো টাকা তুলে নিয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দুর্ভোগ শেষ হয়নি সাধারণ মুসল্লিদের।

স্থানীয় বাসিন্দা মমিন সরকার বলেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে ব্রিজগুলো নির্মাণ করা হয়েছে, সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন হয়নি। জনসাধারণের দুর্ভোগ লাঘবের পরিবর্তে আরো বেড়েছে। লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে ব্রিজগুলো নির্মাণ করা হলেও জনসাধারণের কোনো কাজে আসছে না। অবিলম্বে ব্রিজগুলোর সংযোগ সড়ক করে চলাচলের জোর দাবি জানাচ্ছি।

news24bd.tv

সদর উপজেলার ছাতনী দিয়ার গ্রামের বাসিন্দা মহসিন মন্ডল বলেন, গত এক বছর ধরে শুধু ব্রিজ নির্মাণ করে ফেলে রাখা হয়েছে। কিন্তু কোনো সংযোগ সড়কের জন্য মাটি ফেলা হয়নি। তাছাড়া যাতায়াতের কোনো সড়ক নেই, অথচ নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণ করে ফেলে রাখা হয়েছে। এখন যাতায়াতের জন্য খুব সমস্যা হচ্ছে।

যত্রতত্র এমন ব্রিজ করা আর পরিকল্পনার চেয়ে ছোট ব্রিজ নির্মানের কারণ জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার বানু স্বীকার করেন; এর পেছনে আছে দুর্নীতি ও সরকারি টাকা লোপাটের উদ্দেশ্য।

১৬-১৭ অর্থ বছরে দূর্যোগ ব্যাবস্থাপনা অধিদপ্তরের অর্থায়নে নাটোরের ১১টি ইউনিয়নে অপ্রয়োজনীয় সেতু তৈরির দায় নিতে নারাজ সাবেক প্রকল্প কর্মকর্তা আয়েশা সিদ্দিকা। তাঁর দাবি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সংসদ সদস্যের নির্দেশেই সেতুগুলো নির্মাণ হয়েছে।

যদিও উপজেলা কর্মকর্তা  জেসমিন আকতার বানু বলছেন, প্রকল্প কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজোসেই এমনটা হয়েছে।

নাটোরে অপ্রয়োজনীয় সেতু নির্মাণে ১৫ কোটি টাকার অপচয় অভিযোগ স্থানীয়দের। নাটেরে অহেতুক ১১টি সেতু নির্মাণের দায় নিতে নারাজ কোনো পক্ষই। সাবেক প্রকল্প কর্মকর্তা দোষ চাপাচ্ছেন প্রশাসন ওপর। প্রশাসনের দাবি প্রকল্প কর্মকর্তা আর স্থানীয় প্রভাবশালীদের চাপেই এসব সেতু তৈরি হয়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ তাদের কিছু না জানিয়ে বাড়ির উঠোনে নির্মাণ করা হয়েছিল এই অদ্ভুত সেতু। সেতু নির্মাণের সময় তাদের বলা হয়েছিল অন্যত্র বাড়ি করে দেওয়া হবে। কিন্তু দুই বছরেও সেটি হয়নি। এখন বাড়ির উঠোনে অপ্রয়োজনীয় সেতুর আপোদ সহ্য করতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। অভিযোগ আছে অপ্রয়োজনীয় এসব সেতু নির্মাণের পেছনে ছিলেন উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আয়শা সিদ্দীকা। এখন তিনি পাবনার ভাঙ্গুরা উপজেলায় কর্মরত। তবে তিনি দায় চাপালেন স্থানীয় সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন সকল কর্মকর্তাদের ওপর। তিনি বলেন, এই প্রকল্পে তার সিদ্ধান্তের কোনো তোয়াক্কাই করেনি।

সেতুগুলোর উদ্বোধন করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল। তার দাবি প্রতিটি সেতইু প্রয়োজনীয়।

তিনি বলেন, ১২০-১২৫টি ছোট বড় সেতু আমি নির্মাণ করেছি। এতোগুলো ব্রিজ কেউই নির্মাণ করতে পারেনি।

তিনি আরো বলেন, ব্রিজগুলো নিয়ে জনগণও খুব খুশি। প্রতিটি ব্রীজই জনগণের প্রয়োজনে করা হয়েছে।

(নিউজ টোয়েন্টিফোর/নাসিম/তৌহিদ)

এই রকম আরও টপিক

সম্পর্কিত খবর