রাঙামাটিতে ১৭ মাসে ২৩ খুন!

রাঙামাটিতে ১৭ মাসে ২৩ খুন!

পাহাড়ে ক্ষমতার লড়াইয়ে বাড়ছে খুন, গুম ও অপহরণ
ফাতেমা জান্নাত মুমু  • রাঙামাটি

পাহাড়ে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব ও ক্ষমতার লড়াইয়ে বাড়ছে খুন, গুম ও অপহরণের ঘটনা। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এখন পার্বত্যাঞ্চলের নিত্যদিনের সঙ্গী। প্রতিদিনই কানে আসে খুন, গুম ও অপহরণের খবর। সহিংসতার কিছু ঘটনা প্রকাশ পায়, আবার কিছু পায়না।

 

পাহাড়ের বুকে চাপা পড়েছে হাজারো মানুষের আত্মচিৎকার। এসব ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে মামলা করতে চায় না ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার। তাই দিনের পর দিন পেরুলেও অপরাধীদের বিচার হয়না।

পার্বত্যাঞ্চলে একের পর এক সহিংসতার ঘটনা দেশে আলোচনার ঝড় তুললেও এখনো কোনো সুষ্ঠু সমাধান হয়নি।

এতে বেশ উদ্বিগ্ন পাহাড়ে বসবাসরত সাধারণ মানুষ।  

অন্যদিকে, তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে উপজাতীয় আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর ক্ষমতার লড়াইয়ে কতগুলো নিরীহ মানুষের প্রাণ ঝরেছে, তার সঠিক কোন পরিসংখ্যন জানা না গেলেও শুধু রাঙামাটিতেই গেল এক বছর পাঁচ মাসে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন ২৩জন। এসব ঘটনার প্রতিবাদে ও খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে রাঙামাটিতে ৪৮ঘন্টা হরতালের ডাক দিয়েছিল পার্বত্য বাঙালী ছাত্র পরিষদ ও নাগরিক পরিষদ। যদিও ৭ ঘণ্টা বাদেই হরতাল প্রত্যাহার করা হয়েছে।  

আরও পড়ুন →  রাঙামাটিতে ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিকনেতাসহ নিহত ৫, আহত ৯

সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের তথ্য মতে, ২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের অর্থাৎ ২০১৮ সালে ৪মে পর্যন্ত দুর্বৃত্তের গুলিতে রাঙামাটিতে প্রাণ হারিয়েছেন ২৩জন। গুম ও অপহরণ হয়েছেন কয়েক’শ মানুষ। এসব ঘটনায় চরম নিরাত্তহীনতায় ভুগছেন পাহাড়ি মানুষগুলো। জনমনে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা। বিরাজ করছে চাপা উত্তেজনা।
 
অভিযোগ উঠেছে, ১৯৯৭ সালে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (তৎকালীন শান্তিবাহিনী) ও সরকারের পক্ষে পার্বত্য শান্তি চুক্তি হলেও দীর্ঘ ২০বছরেও পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবও বন্ধ হয়নি, বরং দিনকে দিন তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

এ ব্যাপারে পার্বত্য বাঙালী ছাত্র পরিষদের রাঙামাটি জেলা শাখার সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর আলম অভিযোগ করে বলেন, ১৯৯৭ সালে আগে ছিল শান্তিবাহিনী নামের একটি সশস্ত্র সংগঠন। এখন পার্বত্য চুক্তির পর জন্ম নিয়েছে আরও তিনটি সশস্ত্র সংগঠন। আগে পাহাড়ের মানুষ একটি গ্রুপকে চাঁদা দিত। এখন দিচ্ছে তিনটি গ্রুপকে। এটার নাম শান্তিচুক্তি হতে পারেনা। শান্তির নামে যারা অশান্তি সৃষ্টি করছে, তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন → রাঙামাটিতে উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলি করে হত্যা

সম্প্রতি পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের গুলিতে খুন হন রাঙামাটির নানিয়ারচ উপজেলার চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এ্যাডভোকেট শক্তিমান চাকমাসহ আর ৫জন। এ সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আইনজীবিরাও।

রাঙামাটি জেলা আইনজীবি সমিতির সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী এ্যাডভোকেট সুম্মিতা চাকমা বলেন, রাজনৈতিক অধিকার সবার আছে। কিন্তু রক্তপাত, খুন ও সহিংসতা সৃষ্টি করার অধিকার কারোরই নেয়। এসব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার হওয়া উচিত।

অন্যদিকে, আবারও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (গণতান্ত্রিকের) আহ্বায়ক তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ হত্যাকে কেন্দ্র করে আবারও সহিংসতার আশঙ্কায় স্থবির হয়ে আছে রাঙামাটি জেলার নানিয়ারচর উপজেলা। তাই চারদিনেও রাঙামাটি-নানিয়ারচর-খাগড়াছড়ি-বাঘাইছড়ি-কুতুকছড়ি ও ঘিরাছড়ি সড়কে চলাচল করেনি কোনো যানবাহন। বাসছে না হাট-বাজারও।  

স্থানীয়রা বলছেন, তারা সংঘাত চান না, শন্তি চান। যে কোন মূল্যে পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সরকারের প্রতি জোড় দাবি জানা তারা।

তবে রাঙামাটি জেলা প্রশাসক এ এক এম মামুনুর রশিদ বলেন, সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা দিতে সর্বাত্বক প্রস্তুত প্রশাসন। এসব হত্যাকান্ডের সঙ্গে যারা জড়িত এবং এ ঘটনার পেছনে যারা মদত দিচ্ছে, তাদের খুঁজে বের করতে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও বিজিবি যৌথ অভিযানে নেমছে। দ্রুত জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে।

অন্যদিকে, রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দীপংকর তালুকদার পাহাড় থেকে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বার বার তাগিদ দিয়ে আসছেন। বিভিন্ন সভা ও সমাবেশে তিনি বলেন, পাহাড় থেকে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত এ সংঘাতের অবসান করা সম্ভব না।

উল্লেখ্য, গেল বৃহস্পতিবার (৩ মে) প্রতিপক্ষের ব্রাশফায়ারে রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির (এমএন লারমা) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি শক্তিমান চাকমা নিহত হন।  

পরদিন (৪ মে) তার শেষকৃত্যে যাবার পথে একইভাবে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ইউপিডিএফের (গণতান্ত্রিক) আহবায়ক তপন জ্যোতি চাকমা ওরফে বর্মাসহ পার্বত্য এমএন লারমা লারমা গ্রুপের (সংস্কারপন্থি) যুব সমিতির কেন্দ্রীয় সদস্য তনয় চাকমা (৩১), মহালছড়ি যুব সমিতির সভাপতি সুজন চাকমা (৩০), সেতু লাল চাকমা, (৩৬) ও বাঙালি মাইক্রোবাস চালক মো. সজীবকে (৩৫)নির্মমভাবে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।  

এক রাতের ব্যবধানে প্রকাশ্য দিবালোকে ৬ খুনের ঘটনায় পাহাড়ে নতুন করে অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে।  

মুমু/অরিন/নিউজ টোয়েন্টিফোর

সম্পর্কিত খবর