কী আছে মোদিকে লেখা মমতার ‘ক্ষুব্ধ’ চিঠিতে

নরেন্দ্র মোদি ও মমতা ব্যানার্জি

কী আছে মোদিকে লেখা মমতার ‘ক্ষুব্ধ’ চিঠিতে

অনলাইন ডেস্ক

সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে একটি বৈঠকে গঙ্গা ও তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এতে ক্ষুব্ধ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়। তিনি মোদিকে একটি চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, তিনি পানি নিয়ে আপস করবেন না।  

চিঠিতে মমতা লিখেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সাম্প্রতিক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরের পরিপ্রেক্ষিতে আমি এই চিঠি লিখছি।

জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে গঙ্গা ও তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। রাজ্য সরকারের পরামর্শ ও মতামত ছাড়া এ ধরনের একতরফা আলোচনা গ্রহণযোগ্য বা কাম্য নয়। ’ 

তিনি লেখেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আমি বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসি এবং শ্রদ্ধা করি।

সর্বদা তাদের মঙ্গল কামনা করি। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য অতীতে বিভিন্ন বিষয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছে। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময়ের চুক্তি, যা ছিটমহল নামেও পরিচিত, ইন্দো-বাংলাদেশ রেলওয়ে লাইন এবং বাস পরিষেবাগুলো এই অঞ্চলে অর্থনীতির উন্নতির জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার কয়েকটি মাইলফলক। তবে পানি খুবই মূল্যবান এবং মানুষের জীবন রক্ষা করে। আমরা এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে আপস করতে পারি না, যা জনগণের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এ ধরনের চুক্তির প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি বুঝতে পেরেছি, ১৯৯৬ সালের ভারত-বাংলাদেশ ফারাক্কা চুক্তি ফের নবায়ন করবে ভারত সরকার। চুক্তিটির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হবে। এই চুক্তিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পানি বণ্টনের নীতিগুলোর উল্লেখ আছে। আপনি জানেন, পশ্চিমবঙ্গের জনগণের জন্য ও তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য এই পানির প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ। ’ 

মমতা বলেন, ‘ফারাক্কা ব্যারেজের মধ্য দিয়ে যে পানি সরানো হয়, তা কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। আমি আপনার নজরে আনতে চাই, বহু বছর ধরে ভারত ও বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে নদীর রূপতত্ত্ব পরিবর্তিত হয়েছে; যার ফলে  পশ্চিমবঙ্গ বঞ্চিত হচ্ছে এবং রাজ্যে পানির প্রাপ্যতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। গত ২০০ বছরে গঙ্গার পূর্বমুখী প্রবণতা বেশ কয়েকটি নদীর সঙ্গে সংযোগ বিঘ্নিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, জলঙ্গী ও মাথাভাঙ্গা নদী পদ্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে এবং সুন্দরবনে মিষ্টি পানির প্রবাহ বেড়েছে ‘

তিনি বলেন, ‘ফারাক্কা ব্যারেজ প্রকল্পের নির্মাণের সূচনা হলো গঙ্গা থেকে ভাগিরথীর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা। এই প্রকল্পের অংশ হিসেবে, কলকাতা বন্দরের সঠিকভাবে কাজ করার জন্য কমপক্ষে ৪০০০ কিউসেক পানি সরবরাহ করার জন্য একটি ফিডার খাল তৈরি করা হয়েছে। এটা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে, হুগলিতে পলির প্রবাহও ব্যারেজ তৈরির পর কয়েক বছর ধরে কমে গেছে। এর ফলে নদী ভাঙ্গনের তীব্রতা বেড়েছে এবং ব্যারেজের উজানে এবং ভাটির দিকের এলাকাগুলো অতীতে স্কুল, হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বিদ্যুৎ লাইনের মতো সরকারি অবকাঠামোসহ জীবন ও সম্পদের মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। তাদের আবাসস্থল থেকে তাদের গৃহহীন করা এবং তাদের জীবিকা হারাচ্ছে। হুগলিতে পলির ভার কমে যাওয়ায় সুন্দরবন ব-দ্বীপের শক্ত অবস্থান বিঘ্নিত হচ্ছে। চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরে, ব্যারেজ নির্মাণের পরে নদীর রূপচর্চার সম্ভাব্য পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে, ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রী দেবী গৌড়া একটি চিঠি লিখেছিলেন যাতে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে কেন্দ্রীয় সহায়তা প্রদান করা হবে। রক্ষণাবেক্ষণ এবং মূলধন ড্রেজিং। যদিও সেই অ্যাকাউন্টে ভারত সরকারের কাছ থেকে কোনো তহবিল পাওয়া যায়নি।  

২০০৫ সালে ফারাক্কা ব্যারেজ প্রজেক্ট, অথরিটি (এফবিপিএ) এর এখতিয়ার ১২০ কিমি (ডাউনস্ট্রিমে ৮০ কিমি এবং উজানে ৪০ কিমি) পর্যন্ত প্রসারিত করা হয়েছিল, যাতে এ অঞ্চলে এফবিপিএ দ্বারা প্রয়োজনীয় ক্ষয় রোধ করা যায়। এফবিপিএ এই প্রসারণের জন্য ক্ষয়রোধী কাজের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০১৭ সালে কর্তৃপক্ষের এখতিয়ারে একতরফাভাবে ১২০ কিলোমিটার থেকে কমিয়ে ১৯.৪ কিলোমিটার করা হয়েছিল, যা ধুলিয়ান এবং সমশেরগঞ্জের মতো শহরগুলোসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোকে বাদ দিয়েছিল। এটি এলাকার ভাঙনবিরোধী কাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আমি ইস্টার্ন জোনাল কাউন্সিলের মিটিংসহ বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে বিষয়টি উত্থাপন করেছি। এ বিষয়ে, আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কয়েকবার লিখেছি।  বৈঠকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তিস্তা নদীর স্বাস্থ্য সিকিমে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সিরিজ নির্মাণ, উচ্চ জলাভূমিতে বন উজাড় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ’ 

মমতা লেখেন, ‘শোনা যাচ্ছে, বৈঠকে ভারত সরকার বাংলাদেশে তিস্তা পুনরুদ্ধারের জন্য ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে। আমি অবাক হয়েছি যে, জলশক্তি মন্ত্রী ভারতে নদীটিকে তার আসল রূপ এবং স্বাস্থ্য ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়নি। উল্লিখিত কারণে তিস্তায় পানির প্রবাহ বছরের পর বছর ধরে কমে গেছে এবং অনুমান করা হয় যে, বাংলাদেশের সাথে কোনো পানি ভাগ করা হলে উত্তরবঙ্গের লাখ লাখ মানুষ সেচের পানির অপর্যাপ্ত প্রাপ্যতার কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া উত্তরবঙ্গের বাসিন্দাদের পানীয় জলের চাহিদা মেটাতেও তিস্তার পানির প্রয়োজন। তাই বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন করা সম্ভব নয়। পরিশেষে, আমার দৃঢ় সংকল্প জানাচ্ছি যে, তিস্তার পানি বণ্টন এবং ফারাক্কা চুক্তি নিয়ে কোনো আলোচনাই রাজ্য সরকারের সম্পৃক্ততা ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে করা উচিত নয়। পশ্চিমবঙ্গের জনগণের স্বার্থ সর্বাগ্রে, যার সঙ্গে কোনো মূল্যে আপস করা উচিত নয়। আমি আশা করি, আপনি পশ্চিমবঙ্গের জনগণের প্রয়োজনীয়তা এবং প্রত্যাশাকে উপলব্ধি করবেন এবং আন্তরিকতার সঙ্গে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ’
news24bd.tv/আইএএম