বৈষম্যের বেড়াজালে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার

বৈষম্যের বেড়াজালে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার

ড. মোহাম্মদ জাকির হোসেন

ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) ও সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানের (সিএসপি) অনুসরণে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) সূচনা। স্বাধীনতার সূচনালগ্নে ১৭টি সুপিরিয়র সার্ভিসের মধ্যে শিক্ষা সার্ভিস অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসেস (পুনর্গঠন) আদেশ  ১৯৮০’-তে ১৪টি মূল ক্যাডারে বিসিএস (শিক্ষা) অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৮৬ সালে বিদ্যমান ২৮টি সাবক্যাডারের বিলুপ্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে সংশোধনী এনে ৩০টি ক্যাডারকে সিভিল সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সচিবালয়, বিচার এবং অর্থনীতি ক্যাডার বিলুপ্তি/একীভূতকরণের মাধ্যমে বর্তমানে ক্যাডার সার্ভিসের সংখ্যা ২৭-এ দাঁড়িয়েছে।

সময় পরিক্রমায় সুবিধাপ্রাপ্তিতে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারকে অন্যান্য ক্যাডারের তুলনায় বেতন নির্ধারণ, পদোন্নতিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বঞ্চিত করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, প্রশাসনসহ অন্যান্য ক্যাডার সদস্যরা পঞ্চম গ্রেড থেকে তৃতীয় গ্রেডে পদোন্নতি পান, কিন্তু সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে ব্যতিক্রম করা হচ্ছে। সহযোগী অধ্যাপক (চতুর্থ গ্রেড) থেকে অধ্যাপক পদে আবার চতুর্থ গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। পদোন্নতিতে গ্রেড পরিবর্তন না হওয়া পদোন্নতির সাধারণ শর্তের পরিপন্থী এবং সংবিধান পরিপন্থী।

বৈষম্যের বেড়াজালে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারবিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের অধ্যাপকরা ২০১৫ সালের অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল বাস্তবায়নের আগে সিলেকশন গ্রেড হিসেবে তৃতীয় গ্রেড পেতেন, কিন্তু দুখঃজনক হলেও সত্য যে ২০১৫ সালে অষ্টম  জাতীয় বেতন স্কেল বাস্তবায়নের মাধ্যমে সিনিয়র স্কেল, টাইম স্কেল বাতিল করে শিক্ষা ক্যাডারকে তৃতীয় গ্রেড প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়। এমনকি অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভিন্ন একটি আদেশে তৃতীয় গ্রেডে যাওয়ার রাস্তা সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ করা হয়। ফলে সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সর্বোচ্চ ধাপ অধ্যাপক পদটির মর্যাদাহানিসহ শিক্ষা ক্যাডারের মর্যাদাহানি ঘটে। বর্তমানে অনেক অধ্যাপক চাকরিজীবনের শেষ ৮-১০ বছর বার্ষিক বর্ধিত বেতনবিহীনভাবে একই গ্রেডে অর্থাৎ চতুর্থ গ্রেডে চাকরিজীবন শেষ করতে বাধ্য হচ্ছেন, যেটি তাঁদের সামাজিক মর্যাদার জন্য হানিকর, আর্থিক ও মানসিক কারণ।

উল্লেখ করা যেতে পারে, বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে সহকারী অধ্যাপক (ষষ্ঠ গ্রেড) পদে কেবল পদোন্নতিতে বেতন গ্রেডের পরিবর্তন ঘটে। পরবর্তী সময়ে অধ্যাপক পদ পর্যন্ত পদোন্নতির সব ধাপে বেতন নির্ধারিত হচ্ছে সিলেকশন গ্রেড আর টাইম স্কেলের মাধ্যমে। ২০১৫ সালে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষা ক্যাডার তৃতীয় গ্রেড প্রাপ্তির সুযোগ বিলুপ্তির কারণে বর্তমানে সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপক পদে সব কর্মকর্তাই চতুর্থ গ্রেডে কর্মরত—এমন বিস্ময়কর অবস্থা সুষ্ঠু কর্মপরিচালনার অন্তরায়ই নয়, হতাশাজনকও বটে। বর্তমানে সিলেকশন গ্রেড, টাইম স্কেল না থাকায় এবং সময়মতো নিয়মিত পদোন্নতি না হওয়ায় শিক্ষা ক্যাডারের নবীন সদস্যরা আরো অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, ভবিষ্যতেও হবেন।

সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে বিদ্যমান চরম বেতনবৈষম্যের এই বিষয়টি তুলে ধরে সমাধানের জন্য ৫৯৩ জন অধ্যাপক ২০২১ সালে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল-১-এ মামলা করেন। দীর্ঘ শুনানি ও পর্যালোচনার পর ২০২২ সালের ২৩ নভেম্বর বিজ্ঞ আদালত বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যাপক পদটি তৃতীয় গ্রেডে উন্নয়নের জন্য রায় প্রদান করেন এবং ৯০ দিনের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেন। বিজ্ঞ আদালতের ভাষায়  Ordered ‘the petitioners as professor are entitled to get the grade-III from the date of entitlement and the opposite parties are directed to upgrade the posts of the professor to grade-III within shortest possible period of time preferably within 90 days from the date of receipt of copy of this judgement and order.’

এ ছাড়া বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের বনিয়াদি প্রশিক্ষণ অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে না হওয়ায় আন্ত ক্যাডার সম্পর্ক তেমনভাবে গড়ে ওঠে না এবং চাকরির শুরুতে বনিয়াদি প্রশিক্ষণ না হওয়ায় চাকরি স্থায়ীকরণ বিলম্বিত হয়। ফলে পদোন্নতিতে এর প্রভাব পড়ে। প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপকরা ৮-১০ বছর একই পদে চাকরি করছেন, যেটি কর্মস্পৃহা বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি প্রদান না করার কারণে বিষয়ভিত্তিক বৈষম্যও সৃষ্টি হচ্ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সব পর্যায়ের কর্মকর্তারা। চাকরিতে ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্টের সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতাসহ বৈষম্যের কারণে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রভাষক প্রতিবছর শিক্ষা ক্যাডার ছেড়ে অন্য ক্যাডারে, এমনকি নন-ক্যাডারেও চলে যাচ্ছেন। শিক্ষা ক্যাডার সদস্যরা উপসচিব পদে নিয়োগেও বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন, অন্য ক্যাডারের তুলনায় ব্যাচভিত্তিক অনেক পিছিয়ে থাকছেন, যেটি কাম্য হতে পারে না।

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারকে নন-ভেকেশন ডিপার্টমেন্ট করার প্রস্তাব ১৯৯৬ সালে তৎকালীন সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে আর এগোয়নি। ২০১৮ সালের পর সব ধাপে নিয়মিত পদোন্নতিও হচ্ছে না। পদোন্নতি কার্যক্রম অস্বাভাবিক ধীরগতিসম্পন্ন। ফলে  ২৮-৩০ বছর চাকরি শেষে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে অনেক কর্মকর্তা অবসরে চলে যাচ্ছেন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যলয়ের অধীন অনার্স-মাস্টার্স কোর্সের শ্রেণি কার্যক্রম থেকে শুরু করে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়নসহ ব্যাবহারিক পরীক্ষা গ্রহণ, মূল্যায়নের যাবতীয় কাজ বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় বা প্রশাসনিক পদে শিক্ষা ক্যাডারের সদস্যদের পদায়ন আগে থাকলেও বর্তমানে একেবারেই অনুপস্থিত।

শিক্ষা ক্যাডার সদস্যদের প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্টেরে জন্য দেশে-বিদেশে এমফিল, পিএইচডি করার সুয়োগ নেই বললেই চলে। ২০০০ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ শিক্ষকদের জন্য এমফিল, পিএইচডি প্রগ্রাম চালু করলেও অদ্যাবধি উপযুক্ত কোনো রিসার্চ ল্যাবরেটরির সুযোগ সৃষ্টি করেনি। ফেলোশিপের সংখ্যা, অর্থের পরিমাণ আকর্ষণীয় করা হয়নি। ফলে মানসম্মত গবেষণার সুযোগ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। কৃতিত্বপূর্ণ একাডেমিক ফলাফলসম্পন্ন প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপকদের জন্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বৈদেশিক প্রশিক্ষণসহ উচ্চতর গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি করা আবশ্যক।

যেহেতু শিক্ষা ক্যাডার সংখ্যার দিক থেকে বৃহত্তম, তাই বিভিন্ন ধাপে পদায়নের সুযোগ বৃদ্ধি করা আবশ্যক। শিক্ষাসংশ্লিস্ট দপ্তর, পরিদপ্তর, অধিদপ্তরের বিভিন্ন পদ অন্য ক্যাডার থেকে পদায়ন না করে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সদস্যদের দ্বারা পূরণ করা প্রয়োজন। সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত, অপার সম্ভাবনাময় নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রতিটি ক্যাডারকেই আকর্ষণীয় করে তোলা আবশ্যক, যেন প্রত্যেকেই দেশ গঠনে ও জনমানুষের চাহিদা পূরণে মনোনিবেশ করতে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের কাজ করছে, বিদ্যমান বৈষম্য দূরীকরণে কাজ করছে, মুক্তির সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করছে, তাই আমরা শিক্ষা ক্যাডার সদস্যরাও আশান্বিত যে শিক্ষা ক্যাডারে বিদ্যমান বৈষম্য অচিরেই দূর করা হবে।

এমতাবস্থায় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের চরম বেতনবৈষম্য নিরসনে ক্যাডারের সর্বোচ্চ ধাপ অধ্যাপক পদটি তৃতীয় গ্রেডে উন্নীতকরণসহ প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল-১ কর্তৃক প্রদত্ত রায় বাস্তবায়ন, বিদ্যমান অন্যান্য বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজনীয় আশু পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা, শিক্ষা উপদেষ্টা, আইন উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সবিনয় অনুরোধ করছি।

লেখক : অধ্যক্ষ (পিআরএল) বিসিএস

(সাধারণ শিক্ষা)