‘কিছুদিন ধরে আমাদের হঠাৎ মনে হচ্ছে, আমরা মুক্ত’

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

‘কিছুদিন ধরে আমাদের হঠাৎ মনে হচ্ছে, আমরা মুক্ত’

অনলাইন ডেস্ক

বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্প্রতি এক গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, আমাদের অভ্যুত্থানগুলো ক্রমাগতভাবে বড় ও প্রবলতর হচ্ছে। কিছুদিন ধরে আমাদের হঠাৎ মনে হচ্ছে যে আমরা মুক্ত। প্রথমে অনেকে তো এটা বিশ্বাসই করতে পারেনি। যদিও পরে ধীরে ধীরে বিশ্বাস এসেছে।

দেশে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি আবেগপ্রবণ মানুষ। কিন্তু চিন্তা করার সময় আবেগকে খুব বেশি প্রাধান্য দিই না। আমার মনে হয়, এই বিশ্ববিধানের মধ্যে একটা নিঃশব্দ নিয়ম কার্যকর আছে। তার পথ ধরেই বিশ্বচরাচর চলছে।

এখানে কোথাও বাড়াবাড়ি হলে প্রকৃতির নিয়মই তাকে শমিত করে দেয়। যেমন কিছুদিন আগেও আমাদের বাকস্বাধীনতা থেকে শুরু করে বহু রকম স্বাধীনতা কমে গিয়েছিল। তাই এক বিপুল জোয়ার জেগে উঠে আবার সবকিছুকে মিলিয়ে দিয়ে গেল। এ অনেকটা শেয়ারবাজারের বাজার সংশোধনের মতো বিষয়, চড়াই–উতরাই, উত্থান–পতনের পথে তার যাত্রা।  এই দুটোর সমন্বয়–সামঞ্জস্যের সামনে আমরা সব সময় আছি। এখন তার উত্তুঙ্গ অবস্থা। এর মানে এই নয় যে আগে মানবিক মুক্তির জায়গায় আমরা ২০–এ ছিলাম, এখন এখান থেকে একলাফে ১০০–তে চলে যাব। কিছুদিনের জন্য আমরা হয়তো ৬০, ৭০–এ উঠে যাব। এরপর আবার স্থিত হব, ফিরে আসব আমাদের প্রকৃত বাস্তবতায়। এটুকুও যদি পারি, তাহলেও ধরতে হবে আমাদের মোটামুটি একটা সাফল্য হলো। কারণ, এই আন্দোলনই আমাদের জাতির শেষ আন্দোলন নয়।

অনেকে ভাবেন, আমাদের এবারের জাগরণ একটা ছোট আকারের স্বাধীনতা সংগ্রাম। আমার কিন্তু মনে হয়, স্বাধীনতা একবারই হয়। এরপর যেগুলো হতে থাকে, সেগুলোকে ‘স্বাধীনতা’ না বলে ‘মুক্তি’ বলাই ভালো। স্বাধীনতাযুদ্ধ বারবার হয় না, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ চিরকালীন। চিরকালই আমরা অবরুদ্ধ হব এবং চিরকালই জাগরিত হব। এমনই জাগরণের পর জাগরণের ভেতর দিয়ে ক্রমাগত ঘটতে থাকবে আমাদের উত্তরণ। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স বা জার্মানির আজ যে সভ্য অবস্থা, এটা তো এক দিনে হয়নি। বহু মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে তবেই না তাদের এই সাফল্য।

গণমাধ্যমের সাথে এক প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি জানান, রবীন্দ্রনাথের একটা লেখা পড়েছিলাম। সেখানে তিনি লিখেছেন, তাঁর কোনো একটা মেয়ে তখন খুবই ছোট, হামাগুড়ি দেয়। হঠাৎ সে মেঝের ওপর একটা আরশোলা দেখে কৌতূহলী হয়ে ওটাকে ধরার জন্য এগিয়ে গেল। কিন্তু কবি লক্ষ করলেন, আরশোলাটাকে ধরার জন্য সে একটানা এগিয়ে যাচ্ছে না। যতক্ষণ আরশোলাটা চলছে, ততক্ষণ সে চলছে। কিন্তু আরশোলাটা থেমে পড়লেই সে–ও থেমে যাচ্ছে। আরশোলা আবার চলতে শুরু করলে সে–ও আবার চলতে শুরু করছে দেখে রবীন্দ্রনাথের মনে হলো, এই হলো বিশ্বের গতি, এর চলমানতার ছন্দ; এটা একটানা চলে না, চলে থেমে–এগিয়ে, থেমে–এগিয়ে।

আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জীবনে অনেক আন্দোলন দেখেছি। ১৯৪৭ সালে চোঙা ফুঁকেছি, ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’। বায়ান্নতে এসে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। এরপর উনসত্তর হয়ে একাত্তরের স্বাধীনতাসংগ্রাম। তখন আমাদের পূর্ণ যৌবন। কী রক্তিম রোমাঞ্চ তখন মনে! তারপর স্বাধীন দেশে এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন দেখলাম। প্রতিবারই স্লোগান এসেছে, প্রতিবারই ভেঙেছে দুয়ার, এসেছে জ্যোতির্ময়। এভাবে ভেঙে ভেঙেই আমরা ক্রমাগতভাবে এগিয়েছি।

এসময় তিনি আরও বলেন, আমাদের জনসংখ্যা বাড়ছে, শক্তি বাড়ছে, সম্পদ বাড়ছে। পাশাপাশি আমাদের অবরুদ্ধ করার বৈরী শক্তিও বাড়ছে। তাই আমরা এত বড়ভাবে এসবে সাড়া দিতে পারছি। এটাকে আমি খুব ইতিবাচক হিসেবেই দেখি।

মানুষের জাগরণের সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, জাগরণ দুই রকম। এক ধরনের জাগরণ আছে যা আদিম মানুষের মতো। সহজাত, অন্ধ। সে–ও সামনেই যায়, কারণ সামনে এগোনো বিশ্বপ্রকৃতির নিয়তি। কিন্তু জ্ঞানের মাধ্যমে জাগরণ অনেক বেশি ধীশক্তিসম্পন্ন, মেধাবী, উচ্চায়ত ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। জ্ঞান মানুষের চাহনিকে বড় ও স্বপ্নসমৃদ্ধ করে। আর বই তার উচ্চতর সাফল্যকে নির্বিঘ্ন করে। কাজেই জ্ঞানহীন জাগরণ খণ্ডিত হতে বাধ্য।

news24bd.tv/SC