‘উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ছাড়া জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব নয়’

গোলাম রহমান

‘উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ছাড়া জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব নয়’

উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ছাড়া জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান। দেশের বর্তমান অবস্থা ও উত্তরণসহ সমসাময়িক নানা অর্থনৈতিক ইস্যুতে একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন।  

গোলাম রহমান বলেন, ‘উন্নয়নের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়ন এবং অর্থনীতিকে স্থিতিশীল স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি দরকার।

এছাড়া জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, অবকাঠামোর উন্নয়ন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মানোন্নয়নের মাধ্যমে কর্মজীবী মানুয়ের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং তাদের সুশৃঙ্খল ও নিয়মানুগ করে তোলা। স্থিতিশীলতার অনুপস্থিতিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি আশা করা যায় না। জীবনমানের উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে হলে বিশৃঙ্খলা, ভয়ভীতি ও অনিশ্চয়তা দূর এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।

তিনি বলেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দেওয়া বাজেট রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রণীত হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা শিগগির বাজেটে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবেন বলে এরই মধ্যে ঘোষণা করেছেন। সম্ভবত বাংলাদেশ ব্যাংকের নবনিযুক্ত গভর্নর নতুন মোড়কে মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করবেন। আশা করা যায়, রেমিট্যান্সপ্রবাহের প্রত্যাশিত বৃদ্ধি ও রপ্তানিতে গতিশীলতা অর্জিত হলে এবং আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর কাছ থেকে বর্ধিত ঋণ সহায়তা এলে দ্রুতই রিজার্ভ সমস্যা কেটে যাবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, জ্বালানি এবং ব্যাংকিং খাতের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে কিছুটা সময় দিতেই হবে।
 
মূল্যস্ফীতির বিষয়ে গোলাম রহমান বলেন, ‘বাজেটে মূল্যস্ফীতি ও বার্ষিক উন্নয়নের প্রাক্কলিত হার বাস্তবতাবিবর্জিত, বিগত সরকার জনগণকে বিভ্রান্ত করতে এবং আত্মতুষ্টির লক্ষ্যে এই হার নির্ধারণ করেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যয় এবং বাজেট ঘাটতি কমানোর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। পরিকল্পনা উপদেষ্টা এরই মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বড় ধরনের পরিবর্তন এবং ব্যয় সংকোচনের আভাস দিয়েছেন। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো নাজুক। প্রতিনিয়ত সুযোগসন্ধানী এবং স্বার্থান্বেষী মহল নানা দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে বিব্রতকর ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। উৎপাদন ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও আর্থিক সংকট থেকে উত্তরণ বিলম্বিত হচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং দেশ দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে না এলে অর্থনীতিতে একই সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অনভিপ্রেত মন্দার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। ’

ব্যাংকিং সেক্টর নিয়ে দুদকের এই সাবেক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাংকিং খাতের সমস্যার সূচনা হয়েছিল গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ প্রদানের মধ্য দিয়ে। সময়ের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণদানের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়েই চলেছে এবং ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করার অপসংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। ব্যাংকের মূলধনের একটি অংশ উদ্যোক্তা মালিকদের দেওয়া আর বাকি অংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। ব্যাংকের ব্যবসার অর্থ আসে মূলত আমানতকারীদের জমা থেকে। তাদের জমা করা অর্থের সুরক্ষার দায়িত্ব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের। বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করলে ব্যাংকিং খাতে অনভিপ্রেত খেলাপি ঋণের পাহাড় গড়ে ওঠা অথবা ব্যাংকের উদ্যোক্তা তথাকথিত মালিকদের বিনিয়োগের বহুগুণ অর্থ নামে-বেনামে ঋণ হিসাবে গ্রহণ সম্ভব ছিল না। সরকার বিভিন্ন সময়ে অযাচিতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রভাবিত করে আসছে এবং নানাভাবে, এমনকি আইন সংশোধন করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনায় উদ্যোক্তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করে সংকট ঘনীভূত করেছে। ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের রাজনৈতিক প্রভাব এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃঢ়তার অভাব ও নৈতিক অবস্থান গ্রহণে অনীহা ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধানে প্রধান অন্তরায় ছিল। অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আশা করা যায়, এখন দৃঢ়তার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকিং খাতে নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ খাতকে সংকটমুক্ত করতে সক্ষম হবে। ’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী বিগত জুলাই মাসে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল আরও চড়া, দুই অঙ্কের ঘরে, ১১.৬৬ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪.১০ শতাংশ। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী। মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি সাধারণ মানুষের জীবনমানে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। করোনা মহামারির প্রভাব এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিশ্ববাজারে পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়, পরিবহন ব্যয় বাড়ে এবং পণ্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। এর প্রভাবে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সর্বত্র মূল্যস্ফীতি ঘটে। এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে পণ্য সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। প্রায় সব দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপের ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অন্যদিকে সরকারের অনুশাসনে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার এবং ঋণ ও আমানতের সুদের হার নির্ধারণে ভ্রান্ত নীতি অনুসরণ এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণে অনীহা ও কালক্ষেপণ, বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য টাকা ছাপিয়ে সরকারকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ প্রদান, ডলার-টাকা বিনিময় হারে টাকার মূল্য হ্রাস ইত্যাদি কারণে মূল্যস্ফীতি লাগামহীন হয়ে পড়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে সংকট ঘনীভূত হওয়ায় বিগত সরকার আইএমএফের কাছ থেকে ৪.৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তা গ্রহণ করে। ঋণের শর্ত অনুযায়ী সরকার আর্থিক ব্যবস্থাপনায় সংকোচনমূলক নীতি-কৌশল গ্রহণ করে। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার এবং ঋণ ও আমানতের সুদের হার বহুলাংশে বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। ’

তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়হিদউদ্দিন মাহমুদ, অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দেশের সেরা অর্থনীতিবিদ। দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এখন যোগ্য লোকদের হাতে। আশা করা যায়, উপযুক্ত নীতি-কৌশল অবলম্বন ও বাস্তবায়ন করে তাঁরা শিগগিরই মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে এবং সাধারণ মানুষের জীবনমানের ক্রমাবনতি রোধ করে জনজীবনে স্বস্তি ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সফল হবেন। ’

সরকারি ঋণের ব্যাপারে গোলাম রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের অথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০.৬৩ বিলিয়ন ডলার, সরকারের ঋণ ৭৯.৬৯ বিলিয়ন আর বেসরকারি ঋণ ২০.৯৪ বিলিয়ন। সরকার সাধারণত অবকাঠামো ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এবং বেসরকারি খাত বিনিয়োগ ও ব্যবসা পরিচালনার জন্য ঋণ গ্রহণ করে। উৎপাদনশীল কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহৃত হলে আয় বাড়ে, দেশের উন্নতি হয়, মানুষের জীবনমানে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং ঋণ পরিশোধে সমস্যা হয় না। তবে ঘুষ-দুর্নীতি বা অর্থপাচারে ঋণের অর্থের অপচয় হলে সংকট দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত বৈদেশিক ঋণের কিস্তি বা সুদ পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি। এমন আশঙ্কাও নেই। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এরই মধ্যে ঋণভার লাঘব করার লক্ষ্যে উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে। চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে বলে মনে হয় না। ’

তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনা এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য সরকার রাজস্ব আহরণ ও ঋণ গ্রহণ করে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বাজেট ঘাটতি থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে ঘাটতির পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত হলে মূল্যস্ফীতিসহ নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। রাজনৈতিক বিবেচনায় সরকার কখনো কখনো রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির লক্ষ্যে সঠিক নীতি প্রণয়নে অনভিপ্রেত কালক্ষেপণ করে। বাংলাদেশে কর ও জাতীয় আয়ের আনুপাতিক হার ৮ শতাংশের মতো। এই হার প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে অনেক কম। বাজেট ঘাটতি হ্রাস এবং সরকারের উন্নয়ন ও সেবা কার্যক্রম জোরদার করতে রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। ’

এই রকম আরও টপিক