‘শিক্ষা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি, টাকা ছাড়া কিছু হয় না’

‘শিক্ষা খাতে অনিয়ম-দুর্নীতি, টাকা ছাড়া কিছু হয় না’

জয়দেব দাশ

শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা। তারা বলেন, শিক্ষায় বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, বৈষম্য লেগেই আছে। সেটাকে ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। টাকা ছাড়া কিছুই হয় না।

এমপিওভুক্তির জন্য টেবিলে টেবিলে টাকা দিতে হয়।

রোববার জাতীয় সংসদে ২০২৪০২৫ অর্থ বছরের বাজেটে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মঞ্জুরি দাবির বিরুদ্ধে ছাটাই প্রস্তাবের আলোচনায় এ দাবি করেন। অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী সংসদ সদস্যদের অন্য অভিযোগের জবাব দিলেও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে কিছু বলেননি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মঞ্জুরি দাবির ওপর ছয়জন সংসদ সদস্য ছাঁটাই প্রস্তাব দেন।

এদের মধ্যে পাঁচজন বক্তব্য দেন। জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক রোববার সংসদে অনুপস্থিত ছিলেন।

ছাটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে কুড়িগ্রাম-২ আসনের হামিদুল হক খন্দকার বলেন, শিক্ষায় বরাদ্দ সবসময় জিডিপির লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় পিছিয়ে থাকে। শিক্ষা ব্যবস্থায় বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি, বৈষম্য লেগেই আছে। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক, শিক্ষাক্রম ও আঞ্চলিক বৈষম্য রয়েছে। মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তারা একই কর্মস্থলে ৫/৭ বছর ধরে থেকে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির সাথে যুক্ত থাকে। নতুন কারিকুলাম নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে।

বরিশাল-৪ আসনের পংকজ নাথ বলেন, এনটিআরসিএ-এর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ প্রশংসনীয়। তবে, কুড়িগ্রামের চিলমারীর কেউ যদি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে নিয়োগ পায় তাহলে সে যোগদান করে না। পার্বত্য এলাকায় তো আরো সমস্যা। এ কারণে শিক্ষক নিয়োগের পরেও শিক্ষা কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে। এই নিয়োগটি অঞ্চল ভিত্তিক করার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষা অফিসারদের শূণ্যপদগুলোতে দ্রুত নিয়োগ দিতে হবে।

হাইকোর্ট এমপিদের সভাপতি হতে বারণ করেছেন। বার বার এমপিরা এটা নিয়ে কথা বলেছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন আপীল করবেন। আসলে এমপিদের সবাই অপমান করে। সকলে এমপিদের অসম্মান করতে খুব উৎসাহবোধ করেন। জানি না হাইকোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে আদৌ আপীল করেছেন কী না? আজকে তিনি মন্ত্রী কালকে কোনো কারণে মন্ত্রী না হন তাহলে তার অবস্থাও আমার মতো হবে।

জাতীয় পার্টির হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ভবন হয়েছে কিন্তু শিক্ষার মানের পরিবর্তন হয়নি। আমার নির্বাচনী এলাকায় একটি সরকারি বিদ্যালয়ে ৪৩টি শ্রেণি কক্ষ রয়েছে। পাঠদান হয়নি ৫টিতে। ৫টি রুম ব্যবহার হয়। না হয় আরো ৫টিসহ ১০টি বা ২০টি হলো। কিন্তু রুম ৪৩টি। এই যে অপব্যয়। আমার পাকা বাড়ি, পাকা পায়খানা কিন্তু খাবার নেই। এটা হচ্ছে আজকের শিক্ষার অবস্থা।

তিনি বলেন, এমপিওভুক্ত হয় না। আবেদন গ্রহণও বন্ধ। এক বছর আগে যাদের এমপিওভুক্তির চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাদের পিয়ন চাপরাশির ১/২জনের বেতন হয়েছে অন্যদের বেতন হয় না। হয়তো টাকা নেই। এমপিওভুক্তির জন্য বিভিন্ন টেবিলে যেতে হয়। ধাপে ধাপে টেবিল মানে ধাপে ধাপে দুর্নীতি। একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার ২০/২৫ বছর পরে বেতন হচ্ছে। গ্রামের স্কুল মাদ্রাসায় ৪ তলা ভবন করা হয়েছে। যারা এই পরিকল্পনা করেছে তারা বাংলাদেশে করেন না। তারা গ্রাম দেখেননি।

নাটোর-১ আসনের আবুল কালাম বলেন, রেলের খালাসী পদে ২১শ জন ছেলে-মেয়ের চাকরি হয়েছে যাদের সবাই মাস্টার্স পাস। এটা খুবই কষ্টের বিষয়। আমি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বরাদ্দ বাড়ানোর পক্ষে। কিন্তু আগামী অর্থ বছরে কমপক্ষে ৫ লাখ অনার্স-মাস্টার্স পাস ছেলে-মেয়েদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে কোনো শিক্ষিত বেকার না থাকে।

তিনি বলেন, সর্বক্ষেত্রেই দুর্নীতি। শিক্ষায় ব্যাপক দুর্নীতি। এটা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। টাকা ছাড়া কোনো শিক্ষক অবসর ভাতা পাচ্ছে না। আমার শ্যালক শিক্ষক ছিলেন মারা গেছেন। আমি নিজে তিন বছর তদ্বির করে অবসর ভাতা পায়নি। টাকা ছাড়া কিছুই হয় না। এই সর্বগ্রাসি দুর্নীতি। এই দুর্নীতির কারণে গোটা জাতি গ্রাস হয়ে যাচ্ছে । শিক্ষিত বেকার যুবকরা আত্মহত্যা করছে।

ঝিনাইদহ-২ আসনের নাসের শাহরিয়ার জাহেদী প্রশাসনিক ব্যয় কমিয়ে শিক্ষা গবেষণায় ব্যয় বাড়ানো প্রস্তাব করেন।
সংসদ সদস্যদের বক্তব্যের জবাবে মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, দূরবর্তী জায়গায় অনেকে যোগদান করে না এটা ঠিক। তারপরও বিগত ৬ মাসে ৯৯ হাজার শিক্ষককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। উচ্চ আদালতের আদেশের প্রেক্ষিতে এনটিআরসিএ এর মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। এটি একটি সমস্যা আমরা ইতোমধ্যে চিহ্নিত করেছি। এই যে একটা বাধা আছে আমরা আইন সংশোধনের মাধ্যমে তা নিরসনের চেষ্টা করছি।

এমপিদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির সভাপতি প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীভূক্ত যেসব কলেজ হয়েছে সেখানে এমপিদের গভর্নিং বডির সভাপতি হওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চ আদালত থেকে একটি রায় এসেছিল। যার কারণে সংসদ সদস্যদের সভাপতি করা হচ্ছে না। আমরা ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপীল করার জন্য ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা এটর্নিং জেনারেলের সাথে কথা বলেছি। আইনমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করে এটা আদালত থেকে নিষ্পত্তি করা হবে। আমরা এ বিষয়ে লিভ আবেদন করেছি।

মন্ত্রী বলেন, এবারের বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। শিক্ষার তিনটি মন্ত্রণালয় ছাড়াও আরো ১৯টি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শিক্ষার জন্য ব্যয় হয়। সেগুলোর অর্থ এই হিসেবে কিন্তু আসেনি। আমরা মনে করি শিক্ষার জন্য যে বরাদ্দ সেটা যথাযথ।

আইন মন্ত্রণালয়ের মঞ্জুরি দাবির ওপর ছ ছাঁটাই প্রস্তাবের আলোচনায় অংশ নিয়ে স্বতন্ত্র সংসদ পংকজ নাথ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান অধিকার রক্ষায় কমিশন গঠনের দাবি জানান।

বিরোধী দলের সংসদ সসদ্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, আইন বড় লোকের জন্য। বিচারকের অভাব রয়েছে। বিচারের জন্য এই দরজা ওই দরজা ঘুরত ঘুরতে মানুষের জীবন শেষ। তিনি প্রত্যেক বিভাগে হাইকোর্টের বেঞ্চ করার দাবি জানান।

স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ বলেন, সুন্দর সুন্দর ভবন হয়েছে। কিন্তু লাখ লাখ মানুষ আদালতে ঘুরছে। মামলা জট বাড়ছে।

news24bd.tv/তৌহিদ