আটশো বছর পর সাবেক রূপে ‘নালন্দার’ প্রত্যাবর্তন

ছবি: নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে।

আটশো বছর পর সাবেক রূপে ‘নালন্দার’ প্রত্যাবর্তন

ড. মানস দাস

প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে ‘নালন্দা’ নামটি। কারণ, কারও চোখে এটি ঐতিহাসিক স্থাপনা, কারও চোখে শিক্ষালাভের মহাবিদ্যালয়। বলা হয়ে থাকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ৫০০ বছরেরও বেশি আগে এই প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষা কেন্দ্রে নয় মিলিয়ন বই মজুদ ছিল। যেটা শিক্ষা প্রদানের জন্য সারাবিশ্বের ১০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীকে আকর্ষণ করেছিল।

তিব্বতী বৌদ্ধদের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা বলেছিলেন, 'আমাদের (বৌদ্ধ) সকল জ্ঞানের উৎস নালন্দা এবং এখান থেকেই এসেছে। ' গৌরবময় প্রতিষ্ঠানটি সুদূর অতীতের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। কিন্তু এর ক্যারিশমা এতটাই ছিলো যে ধ্বংসের ৮০০ বছরেরও বেশি সময় পরে এটিকে পুনরুজ্জীবিত করার তাগিদ অনুভূত হয়েছে।

চলতি বছরের ১৯ জুন নতুন ক্যাম্পাসের উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের পরিচয়, সম্মান, মূল্য এবং মন্ত্রকে চিত্রিত করে।

মোদি সেসময় বেশ জোর গলায় বলেন, 'অগ্নিশিখা বই পুড়িয়ে ফেলতে পারে, কিন্তু এটা জ্ঞানকে মুছে ফেলতে পারে না। '

নতুন ক্যাম্পাসটি ঐতিহাসিক ও বৌদ্ধ অধ্যয়ন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, হিন্দু অধ্যয়ন (সনাতন ধর্ম), দর্শন ও ধর্ম, বিশ্ব সাহিত্যের পাশাপাশি বাস্তুবিদ্যা এবং পরিবেশ অধ্যয়ন এবং টেকসই উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার মতো আধুনিক বিষয়ে মাস্টার্স এবং পিএইচডি প্রোগ্রাম অফার করছে।

তবে শুরুর দিকে নালন্দার দিনগুলো ছিলো আসলে ভুলে ভরা। আর্থিক অব্যবস্থাপনা, চ্যান্সেলর, ভিসি, শিক্ষক ও প্রশাসক নিয়োগে ভুল সিদ্ধান্ত, পাঠ্যক্রম এবং অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা থেকে শুরু করে অনেকগুলো সমস্যা এবং বিতর্কের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। তৎকালীন চ্যান্সেলর এবং নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের প্রস্থানের পরপরই শুরু হয় হতাশার ঢেউ। যেন এক বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের নতুন সংস্করণের অকালমৃত্যু ঘটে। কিন্তু দীর্ঘ সময় পরে আধুনিক ক্যাম্পাসের উদ্বোধনে যেন আবার প্রাণ ফিতে শুরু করেছে ক্যাম্পাসে।

ভারতের দূরদর্শী সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম ২০০৬ সালে প্রথম নালন্দা পুনরুজ্জীবিত করার প্রকল্পের প্রস্তাব করেন। পরবর্তীকালে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়টি নির্মাণের জন্য সংসদে একটি বিল পাস হয়। বিহার সরকার এটির নির্মাণের জন্য ৪৫৫ একর জমি বরাদ্দ করে। ২০১৪ সালে শিক্ষার্থী তালিকাভুক্তি শুরু হলেও এটি অল্প সময়ের মধ্যেই সমস্যার সম্মুখীন হয়। অমর্ত্য সেনের প্রস্থানের পর বেশ কয়েকজন অনুষদ সদস্য প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ও উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। সঠিক গাইডের অভাব, পাঠ্যক্রম পরিবর্তন, অপর্যাপ্ত কর্মী শক্তি এবং হোস্টেল সুবিধার বিষয়েও অভিযোগ ছিল তাদের।

এরপর আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ নতুন ক্যাম্পাস তৈরি করতে প্রায় এক দশক সময় লেগেছে। ক্যাম্পাসের উদ্বোধনের সময়ে বিপুল সংখ্যক বিদেশি বিশিষ্টজনের উপস্থিতি ও তাদের গভীর আগ্রহ এই ইঙ্গিত দেয় যে নালন্দা তার ঈর্ষণীয় উত্তরাধিকার ফিরে পেতে চলেছে। যেটি বিশ্বব্যাপী আরেক বিখ্যাত কেন্দ্রে রূপান্তরিত হতে চলেছে।

প্রাচীন ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ মহাবিহার এবং অষ্টম শতাব্দীর শেষভাগে পাল সম্রাট ধর্মপাল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত 'বিক্রমশিলা'। এটিও ১১৯৩ সালের দিকে বখতিয়ার খিলজি দ্বারা ধ্বংস হয়ে যায় এবং আজ এটি শুধুমাত্র একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। কিন্তু বিক্রমশীলার তুলনায় নালন্দার শিক্ষার্থী ছিলো ১০ গুণ।

নালন্দার সমসাময়িক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ইউরোপের প্রাচীনতম ইতালির বোলোগনা বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য। ১০৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো এই বিশ্ববিদ্যালয়। তবে সে সময়ে নালন্দা ছয়শো বছরেরও বেশি সময় পার করে ফেলেছে এবং এশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ থেকে স্নাতকদের পাঠদান করে আসছিলো। রাজগীর পাহাড়ের কাছাকাছি অবস্থিত প্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় যেটি ৪২৭ খ্রিস্টাব্দে মহান গুপ্ত সম্রাট কুমারগুপ্ত প্রতিষ্ঠিত করেন। ধ্বংস হওয়ার আগে এটি আট শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সর্বোচ্চ হিসেবেই রাজত্ব করেছিল।

চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ৬৩৭ সালে ভারত সফরের সময় নালন্দা মঠের প্রধান ছিলেন শীলভদ্র। হিউয়েন সাং সেখানে পাঁচ বছর অবস্থান করেন। সেখানে তিনি শীলভদ্রের নির্দেশনায় যোগশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন এবং এই প্রাচীন প্রতিষ্ঠানের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

আরেক চীনা পর্যটক ইজিংও নালন্দায় শিক্ষালাভের মর্মস্পর্শী বিবরণ রেখে গেছেন। তার হিসাব অনুযায়ী, নালন্দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন লেকচার হলে একদিনে ন্যূনতম একশটি বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হতো। বিশাল গ্রন্থাগারটিতে তিনটি বিশাল ভবন ছিল যার মধ্যে 'রত্নসাগর' ছিল নয় তলা বিশিষ্ট যেখানে সবচেয়ে মূল্যবান বই এবং পাণ্ডুলিপি রাখা ছিল। নালন্দার মূল উপনিষদে ছিল সংস্কৃত বই ও পাণ্ডুলিপির ভাণ্ডার ‘অস্ত্রসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’ যার সবকটিই খিলজি অত্যন্ত জঘন্যভাবে পুড়িয়ে ফেলেন।

বলা হয়ে থাকে নালন্দার ধংসে ভারতীয় উপমহাদেশে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, আলকেমি এবং অ্যানাটমিতে প্রাচীন ভারতীয় বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার মৃত্যু ঘটে। ধ্বংসের ভয়াবহতা দেখানোর জন্য এর উত্তরাধিকার চালু রাখতে কোনো সম্রাট পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করেনি।

তবে প্রতিষ্ঠানটির নতুন প্রত্যাবর্তনে আশার সঞ্চার যুগিয়েছে শিক্ষানুরাগীদের মনে। তারা মনে করছেন, নালন্দা সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে আরও বেশি গ্রহণযোগ্য এবং শিক্ষাদানের আদর্শ কেন্দ্র হতে পারে যেমনটি আগে ছিল। শুধুমাত্র এশিয়ার গর্ব নয়, নালন্দা তার প্রাচীন গৌরব এবং আদর্শ সারা পৃথিবীর সামনে তুলে ধরার মতো।

[লেখাটি LOOKEAST থেকে অনুবাদিত। লেখকের মতামতের জন্য নিউজটোয়েন্টিফোর টেলিভিশন দায়ী নয়। লেখক ড. মানস দাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে পিএইচডি এবং একজন ফ্রিল্যান্স লেখক। ]

news24bd.tv/FA