অপ্রদর্শিত আয় ও মূল্যস্ফীতি

অপ্রদর্শিত আয় ও মূল্যস্ফীতি

মো. শাহাদাৎ হোসেন

গত ৩০ জুন ২০২৪ মহান জাতীয় সংসদে পাস হলো ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। বাজেট হচ্ছে একটি দেশের একটি নির্দিষ্ট আর্থিক বছরের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার দলিল। ৬ জুন ২০২৪ জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট পেশ হওয়ার পর মাননীয় সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন মহলের আলাপ-আলোচনা ও বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রস্তাবিত বাজেট কিছু সংশোধনী বা পরিবর্তনসহ সংসদের অনুমোদন লাভ করে। প্রস্তাবিত বাজেটে যে কয়েকটি বিষয়ে পরিবর্তন এসেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হচ্ছে, ব্যক্তি করদাতার সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ না করে আগের মতোই ২৫ শতাংশ বহাল রাখা।

সেই সঙ্গে এটিও নিশ্চিত করা হয়েছে যে আগামী অর্থবছরে এটি ৩০ শতাংশ হবে। এ সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে বাস্তবসম্মত ও যুক্তিযুক্ত। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে প্রস্তাবিত করহার প্রয়োগ করা হবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আয়ের ওপর। যেহেতু করদাতা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আয় অর্জনের সময় জানতেন সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ, সে হিসেবেই তাঁর আর্থিক পরিকল্পনাটি করে থাকেন, কিন্তু হঠাৎ করে যদি সেই পরিকল্পিত কর দায় বৃদ্ধি পেয়ে যায়, তবে সেটি করদাতার জন্য অনাকাঙ্ক্ষিত বোঝা হিসেবে দাঁড়ায়।

৩০ শতাংশ করহার ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে প্রযোজ্য হলে আগে থেকেই একটি আর্থিক পরিকল্পনা করতে পারেন, সে দৃষ্টিকোণ থেকে ২০২৫-২৬ অর্থবছর থেকে সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশ হবে, যেটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে অনুমোদন করা বাস্তবসম্মত ও যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত। চূড়ান্ত বাজেটে কোনো পরিবর্তন না এলেও যে বিষয়টি নিয়ে সংসদের ভেতরে-বাইরে বেশ সমালোচনা হয়েছে বা এখনো হচ্ছে সেটি হলো, ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ। যদিও বাজেটে সেটিকে অপ্রদর্শিত আয় বা সম্পদকে প্রদর্শন করার সুযোগ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনার ক্ষেত্রে যে যুক্তিটি খুব জোরেশোরে উঠে আসছে সেটি হচ্ছে, অবৈধ অর্থ উপার্জন করলে কর দিতে হবে ১৫ শতাংশ, পক্ষান্তরে বৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনে কর দিতে হবে ২৫ শতাংশ হারে, যা শুধু অযৌক্তিকই নয়, রীতিমতো অবিচার।

সমালোচনার উপাদানগুলো তাত্ত্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও বাস্তবতার নিরিখে কতটা যৌক্তিক, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
পৃথিবীতে যত রকম পদ্ধতি বা system-এর কথাই বলা হোক না কেন প্রত্যেক পদ্ধতির ক্ষেত্রেই রয়েছে ‘পদ্ধতিগত কিছু ক্ষতি’, যেটিকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ system loss’। পাট থেকে চট বা অন্য যেকোনো পাটজাত পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে মেশিনে যে পরিমাণ কাঁচা পাট দেওয়া হয়, তার শতভাগই কিন্তু ফিনিশড প্রডাক্ট হিসেবে বের হয় না, কিছুটা system loss  হয়, যা wastage হিসেবে বাজারে বিক্রি করা হয় অপ্রদর্শিত আয় ও মূল্যস্ফীতিঅনেক কম দামে। এ প্রশ্ন কি উত্থাপন করা সম্ভব যে একই পাটগাছের আঁশ একটি অংশ প্রক্রিয়াপূর্বক বিক্রি হলো উচ্চমূল্যে আর কিছু অংশ কেন বিক্রি হলো খুব কম মূল্যে? উত্তর হচ্ছে, না। অনুরূপভাবে ব্যাংক ব্যবসার অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে ঋণ প্রদান করা।

বিশ্বের যত উন্নত ব্যাংকই হোক না কেন, কিছু ঋণ খেলাপি হবে এবং তা আদায় করার জন্য সুদ মওকুফ করতে হবে। কত শতাংশ খেলাপি ঋণ গ্রহণযোগ্য, সেটি নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, তবে ব্যাংক ব্যবসা করতে হলে ঋণ খেলাপি হবেই। এখানেও প্রশ্ন আসতে পারে, যিনি ভালো ঋণগ্রহীতা তিনি অধিক সুদ পরিশোধ করছেন আর যিনি খেলাপি তিনি মওকুফের কারণে কম সুদ পরিশোধ করছেন। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এরূপ প্রশ্ন উত্থাপন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই, কেননা ব্যাংক ব্যবসার ক্ষেত্রে এটি system loss। পাশাপাশি এটাও উল্লেখ্য, বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব রয়েছে এবং প্রত্যেক তত্ত্বের কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন—অর্থনীতির একটি তত্ত্ব হচ্ছে ‘পণ্যের দাম বাড়লে চাহিদা কমে’। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাম বাড়লেও চাহিদা না কমে বরং আরো বেড়ে যায়। উদাহরণসরূপ, কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লে ক্রেতাসাধারণ ভবিষ্যতে দাম আরো বাড়বে মনে করে কেনা বাড়িয়ে দেয়।

১৫ শতাংশ কর দিয়ে এ বছর অপ্রদর্শিত আয় বা সম্পদ প্রদর্শন করার যে সুযোগ তার পেছনের কারণ মাননীয় অর্থমন্ত্রী খুব স্পষ্ট করেই বাজেট বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তারপরও সমালোচনার কারণ, এই সুযোগ শুধু এ বছরই নয় প্রায় প্রতিবছর প্রতিটি সরকারই দিয়ে আসছে। সুযোগ যতই দেওয়া হোক না কেন, এনবিআরের বরাত দিয়ে পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মোতাবেক এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সব মিলিয়ে অপ্রদর্শিত প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা ঘোষণায় এসেছে, অর্থাৎ সাদা হয়েছে। গড়ে নিয়মিত করহার ২০ থেকে ২২.৫ শতাংশ যদি ধরা হয় তবে ৪৭ হাজার কোটি টাকার ওপর কম কর আদায় বা ক্ষতির পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। দেশে এ পর্যন্ত যে কর আদায় হয়েছে তার সঙ্গে এই কম কর আদায় বা ক্ষতি পাঁচ হাজার কোটি টাকা কোনোভাবেই ০.৫ শতাংশের ওপরে যাবে না বলেই অনুমেয়। সুতরাং এই পাঁচ হাজার কোটি টাকা কম কর আদায় বা ক্ষতি কর আদায় ব্যবস্থার সিস্টেম লস বললে অযৌক্তিক হবে না, কিংবা দেশের কর আদায় তত্ত্বের ব্যতিক্রম হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ইংরেজিতে একটি কথা আছে  ‘exception can not be example’ অর্থাৎ ব্যতিক্রম কোনো সময় উদাহরণ বা রেফারেন্স হতে পারে না। সুতরাং সিস্টেম লস বা তত্ত্বের ব্যতিক্রম হিসেবে কর রাজস্বের যে ক্ষতি, তা কোনো নিয়মিত করদাতাকে নিরুৎসাহ বা প্রভাবিত করতে পারে না। তবে যদি প্রমাণিত হয় যে অবৈধ উপায়ে, অর্থাৎ ঘুষ বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ উপার্জিত হয়েছে, সে ক্ষেত্রে কেবল কর প্রদান উক্ত দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে যেন কোনো বাধা সৃষ্টি না হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

বাজেটের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে মূল্যস্ফীতি রোধ। বাজেটে মূল্যস্ফীতি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬.৫ শতাংশ, যা বর্তমানে বিদ্যমান ৯ শতাংশের ওপর। মূল্যস্ফীতিকে রোধ করার জন্যই সম্ভবত এবারের বাজেটে পূর্ববর্তী বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় গ্রোথ অনেকটা সংকুচিত রাখা হয়েছে। খরচের গ্রোথ প্রাক্কলন করা হয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। জানুয়ারি-জুলাই সময়কালের জন্য সংকুচিত মুদ্রানীতি ঘোষণা ও বাস্তবায়ন করা হলেও মূল্যস্ফীতি রোধে খুব একটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। কারণ আমাদের মূল্যস্ফীতির মূলে ছিল ব্যয় বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি বা cost push inflation ব্যয় বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতি রোধে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি যতটা না কার্যকর ভূমিকা পালন করে, তার চেয়ে বেশি কার্যকর হয় যদি মুদ্রার ব্যবহার হয় উৎপাদনশীল খাতে। সুতরাং বাজেটে যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে, তার প্রতিটি অর্থ যেন উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে। অর্থের অপচয় রোধ ও উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করেই আমাদের মূল্যস্ফীতি রোধ করতে হবে।

লেখক : এফসিএ, কাউন্সিল সদস্য ও সাবেক সভাপতি, দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)