অর্থনীতি ঘোরাতে গতিশীলতা প্রয়োজন ব্যবসা-বাণিজ্যে

চট্টগ্রাম বন্দর

অর্থনীতি ঘোরাতে গতিশীলতা প্রয়োজন ব্যবসা-বাণিজ্যে

অনলাইন ডেস্ক

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্য উপদেষ্টারা বৃহস্পতিবার রাতে শপথ গ্রহণ করেছেন।  বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশ সচল করতে অর্থনীতিতে দ্রুত গতিশীলতা আনাই সরকারের অন্যতম লক্ষ্য হবে বলে প্রত্যাশা করেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। তাঁরা মনে করছেন, যদিও এটি করার ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।  

বর্তমানে দেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচকের অবস্থাই নাজুক।

হোঁচট খেয়েছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছে। এই অবস্থায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও অর্থনীতিতে দ্রুত গতিশীলতা আনার আহ্বান জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। অর্থনীতিতে লম্বা সময় ধরেই চলছে সংকট।

এ অবস্থায় গত কয়েক দিনের সহিংসতায় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের আরো বড় ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখন ব্যবসা-বাণিজ্য তথা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তাঁরা মনে করছেন, বর্তমানে অর্থনীতিতে দুটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে—সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল করা এবং অর্থনীতির বর্তমান সংকটগুলো সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া।

চলমান পরিস্থিতিতে গত মঙ্গলবার থেকে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ও অফিস-আদালত চালু হয়েছে। কিন্তু নিরাপত্তা শঙ্কায় অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। একইভাবে নিরাপত্তাঝুঁকিতে শিল্প-কারখানা পুরোপুরি চালু করা যায়নি। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য খালাস ও কাস্টমসের কার্যক্রমে রয়েছে ধীরগতি। এ কারণে ব্যাহত হচ্ছে বাণিজ্য।

বাধাগ্রস্ত হচ্ছে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি। বিঘ্নিত হচ্ছে দেশে সামগ্রিক সরবরাহ ব্যবস্থা। সংকুচিত হচ্ছে রপ্তানি কার্যক্রম। এতে দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া ঝুঁকিতে থাকা ব্যাংক খাতের দুর্বল অবস্থা ও অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে অর্থনীতিকে গতিশীল করা চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এই অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণে পদক্ষেপ প্রত্যাশা করছেন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কতটা সক্ষম হবে, তা নিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নতুন সরকারের জন্য অনেক বড় চ্যলেঞ্জ আছে। সে অনুযায়ী আরও শক্তিশালী টিম দরকার ছিল। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় দিক থেকে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে এই টিম যথেষ্ট নয়। তাদের সামনে অনেক কাজ। বিশেষ করে রাজনৈতিক দিক থেকে অনেক জোর লাগবে। এ ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে। আবার অর্থনৈতিক দিক থেকেও যথেষ্ট অভাব আছে। ’

তিনি বলেন, ‘এই সময়ে নতুন সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খুব দ্রুত অর্থনীতি গতিশীল করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ঘুষ রোধ করা এবং সেবা পাওয়ার সময় কমাতে হবে, যাতে অর্থনীতি দ্রুত গতিশীল করা যায়। যদিও এটা সহজ নয়। এই টিমে আরো অভিজ্ঞ লোকের প্রয়োজন ছিল। কারণ নীতিগত ও কাঠামোগত অনেক সংস্কার করতে হবে। সামষ্টিক অর্থনীতির নীতিগত অনেক সংস্কার করা আছে। এটা আরো যাচাই-বাছাই করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের অবস্থা ভালো নয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে ভালো অবস্থায় নিতে হবে। রাজস্ব আয় বাড়াতে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজন আছে। কৌশলগত পর্যালোচনার মাধ্যমে কাস্টমসের সংস্কার করতে হবে। এটা নতুন সরকার পারবে কি না জানি না। সে রকম লোক দেখছি না। ’

আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘দেশের স্থানীয় সরকার কাঠামোর পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের কাজগুলো জেলা পর্যায়ে ভাগ করে দিতে হবে। তাদের নিজস্ব প্রক্রিয়ায় রাজস্ব আয় বাড়িয়ে সমন্বয় করতে হবে। এই সরকারকে সংস্কার আনতে হলে সময় দিতে হবে। ’   

গত বুধবার বর্তমান ব্যবসার দুরবস্থা তুলে ধরেন চট্টগ্রাম চেম্বারের মহাসচিব মোহাম্মদ ফারুক। সংগঠনটির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিশীলতা আনতে আহ্বান জানানো হয়। একই সঙ্গে আমদানিনির্ভর কাঁচামালের সংকট এবং রপ্তানি বিলম্বের দ্রুত সমাধান চাওয়া হয়েছে।

মোহাম্মদ ফারুক বলেন, বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি কমে গেছে। তাই জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের স্বাভাবিক কাজের গতি ফিরিয়ে আনতে হবে। এ ছাড়া সব সরকারি অফিস, শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তথা বেসরকারি খাতের পথ চলাকে নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন রাখতে জরুরি ভিত্তিতে সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সব সরকারি ও বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নিরাপত্তা বিধান এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ পুনরুদ্ধার, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নীতি প্রণয়ন এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির আধুনিক ও উন্নত বাংলাদেশ নির্মাণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে চট্টগ্রাম চেম্বার সহযোগী ভূমিকা পালন করবে।

প্রায় ২০ দিন ধরে বন্ধ ঢাকার টঙ্গীতে খাদ্য প্রস্তুতকরণ প্রতিষ্ঠান সতেজ ফুড। ৩০ জনের বেশি কর্মী কাজ করেন এই প্রতিষ্ঠানে। ২০ দিনে প্রায় ১২ লাখ টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মোস্তফা কামাল। সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘আমরা আজ (বৃহস্পতিবার) থেকে কারখানা চালু করেছি। তার আগে মাঝেমধ্যে বাসা থেকে কারখানা ঘুরে যেতাম। কর্মীদের সব কাজ বন্ধ ছিল। এখন আবার চালু করেছি। যেসব স্থায়ী কর্মী রয়েছে তাদের ১৫ দিনের বেতন দিতে হবে। তাদের থাকার ব্যবস্থা করা আছে, সেই খরচও দিতে হবে। একটি বিদেশি ক্রেতা খাবারের ক্রয়াদেশ দিয়েছিল তাদের সরবরাহ করতে পারিনি। এটাও তো বড় ক্ষতি। ’

জাতীয় ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতি বাংলাদেশের (নাসিব) প্রেসিডেন্ট মির্জা নূরুল গণী শোভন (সিআইপি) বলেন, ‘এখন দেশের পরিবর্তিত পরস্থিতিতে ব্যবসার পরিবেশ অনুকূল নয়। কারণ দেশে শিল্প খাত ঠিক না হলে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হবে। দ্রুতগতিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। ’

তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের ঋণ অনেক বেড়ে গেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের রক্ষা করতে লাগামহীন সুদের হার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আট থেকে ১০ দিন ধরে বেশির ভাগ কারখানাই বন্ধ রয়েছে। নিরাপত্তাহীনতার কারণে বন্ধ রাখা হয়েছে। দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে কারখানা দ্রুত চালু করতে হবে। নতুন সরকার যেন এদিকে নজর দেয়, সেই প্রত্যাশাই করি। ’  

দেশের এই সন্ধিক্ষণে একটি নিরাপদ, বৈষম্যহীন ও মানবিক সমাজ গঠনে কাজ করে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। এই অর্জনের মধ্যেও কিছু দুষ্কৃতকারী ও ষড়যন্ত্রকারী বিভিন্ন স্থানে জনগণের জানমাল, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানায় হামলা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ব্যবসায়ীসমাজ এ ধরনের ঘৃণিত কাজের হোতাদের ধিক্কার জানাচ্ছে। একই সঙ্গে নতুন সরকারের কাছে ব্যবসা-বাণিজ্যে নিরাপত্তা দাবি করছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই।  

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমে গতি ফিরিয়ে আনতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সার্ক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এসসিসিআই)।

সার্ক চেম্বারের সভাপতি মো. জসিম উদ্দীন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম, সরবরাহব্যবস্থাসহ দেশের বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে। ফলে উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এমন বাস্তবতায় দ্রুত সময়ের মধ্যে যথাযথ ও কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে অর্থনীতি আরো ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

রাজধানীসহ দেশব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারের আহ্বান জানিয়েছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অতিদ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়েছে সংগঠনটি।

news24bd.tv/আইএএম