গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারুণ্যের শক্তি আবিষ্কার

এ কে এম শাহনাওয়াজ

গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারুণ্যের শক্তি আবিষ্কার

এ কে এম শাহনাওয়াজ

আমাদের কিশোর তরুণরা এক অভাবনীয় গণজাগরণ ঘটিয়ে দিল। দীর্ঘদিন সিন্দাবাদের বুড়োর মতো দেশের ঘাড়ে চেপে থাকা শেখ হাসিনার সরকার গণজোয়ারের তোড়ে নেমে যেতে বাধ্য হয়। কোনো কোনো সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত বলার চেষ্টা করছেন, পর্দার অন্তরাল থেকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের অঙ্গুলিহেলনে এই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। এমনটি বলে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের গৌরবকে কি কোনো পক্ষ খাটো করতে চাচ্ছে! ঘটনার পারম্পর্য দেখলে এসব বক্তব্য মানা কঠিন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রধানত সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে আন্দোলনে নেমেছিল। দাবি মেনে নেওয়াটা সরকারের জন্য জটিল কিছু ছিল না। যদি সরকারপ্রধান বা তাঁর দায়িত্বশীল প্রতিনিধি সূচনায়ই ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসতেন—আমাদের বিশ্বাস, চা খেতে খেতেই সব ফায়সালা হয়ে যেত। এমনটি হলে আন্দোলন পল্লবিত হওয়ার কারণ থাকত না।


আওয়ামী লীগ নেতা ও সরকারপ্রধানের আত্মম্ভরিতা প্রদর্শন এবং আন্দোলনকারীদের মনস্তত্ত্ব না বুঝে তুচ্ছজ্ঞান করার কারণে দিনে দিনে আন্দোলন ভিন্ন মাত্রা নিতে থাকে। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের অস্ত্র হাতে আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হওয়ার পর থেকে বারুদে আগুন লাগে। আন্দোলন আরো বড় হয়। এরপর লেলিয়ে দেওয়া হয় পুলিশ।

হতাহতের ঘটনা ঘটতে থাকে। তা স্ফুলিঙ্গের মতো দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। এমন বাস্তবতাকে কাজে লাগাতে কথিত দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা যদি আগুনে বাতাস দেয়, তো দিতে পারে। এতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের চেতনা ম্লান হয় না।

এ সত্য মানতে হবে যে কিশোর-তরুণ প্রজন্ম তাদের বুকে থাকা দেশপ্রেমের যে শক্তির প্রকাশ দেখাল, তা অমূল্য।

একে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। এ কারণেই আমাদের দায়িত্বশীলদের সর্বাত্মক সতর্ক থাকা প্রয়োজন। গণজাগরণে সাফল্যের নায়ক শিক্ষার্থীরা—এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ কারণে আবেগের বশবর্তী হয়ে যদি কিশোর-তরুণদের সঠিক পথনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হই, তবে এর পরিণতি হতে পারে ভয়ানক। বিপ্লবী তরুণরা আমাদের একটি মরচে ধরা অচলায়তন ভেঙে দিয়ে সহজ করে দিয়েছে। এখন দায়িত্বশীল ও দায়িত্ববানদের সঠিক পথের দিশা পাওয়া উচিত। তাঁদের প্রজ্ঞা, মেধা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন ও দেশপ্রেমের মূল্য দেওয়া উচিত। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের যা করা উচিত নয়, তা করতে থাকলে অচিরেই ওরা বিতর্কিত হয়ে উঠবে। তখন সুযোগটি লুফে নেবে অন্যায়কারী ও দুর্নীতিবাজরা।

গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারুণ্যের শক্তি আবিষ্কারঅন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর ধারণা করেছিলাম আন্দোলনের শক্তিকে সংরক্ষণ করে তরুণরা সব অন্যায়-অনাচারের বিরুদ্ধে একটি সত্যিকার অর্থে প্রেশার গ্রুপ হিসেবে থাকবে। কিন্তু যখন দেখা গেল সমন্বয়কদের কেউ কেউ সরকারের অংশ হয়ে গেল, তখনই স্পষ্ট হতে থাকে ছাত্রশক্তি এখন বিভক্তির দিকে যাচ্ছে। এরপর দেশের নানা অঞ্চলে শিক্ষার্থীদের কোনো কোনো অংশ প্রকৃত দুর্নীতিবাজ, কথিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বলপূর্বক পদত্যাগ করাতে থাকল। এসব দৃশ্যে অনেকে বাহবা দিলেও আমি শঙ্কিত হচ্ছি প্রতিদিন। আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বিশাল বিজয় ছিনিয়ে আনল যারা, তাদের তো কাজ এটি হতে পারে না। দেখা গেল নতুন সরকার সামান্য থিতু না হতেই সব অফিস-আদালত আর প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা একযোগে দাবিদাওয়ার পাহাড় নিয়ে সরকারের মুখোমুখি হচ্ছেন। কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে যে তরুণরা কয়েক দিন আগেই বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছিল, আজ তাদেরই কেউ কেউ কিছুটা জেনে, কিছুটা কানকথা শুনে নিজেদেরই শিক্ষক-শিক্ষিকাকে চরম অপমান করে পদত্যাগ করাচ্ছে। নওগাঁর এক অধ্যক্ষ তো অপমান সহ্য করতে না পেরে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করলেন। এ ধরনের করুণ ঘটনা অনেক ঘটে যাচ্ছে। এভাবে নন্দিত উজ্জ্বল কিশোর-তরুণরা নিন্দিত হতে থাকবে, তা কাম্য হতে পারে না। তরুণদের কেউ কেউ বুঝতে পারছে না অনেক জটিল সুবিধাবাদী বড়রা ওদের উসকে দিয়ে নিজেদের ফায়দা তুলে নিচ্ছেন। কোনো শিক্ষক, কোনো কর্মকর্তা যদি অন্যায় করে থাকেন, যদি তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে, তাহলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ পেশ করা যেতে পারে। চাপ সৃষ্টি করা যেতে পারে, যাতে ন্যায়বিচার করা হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক নির্দেশনাও তেমন। কয়েক দিন আগেও শিক্ষার্থীরা যখন দেশজুড়ে সড়কে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছিল, তখন ওদের দায়িত্ববোধ দেখে অনেকে সমীহ করতে শুরু করে। অনভিজ্ঞতা সত্ত্বেও এ সময় সড়কও নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল অনেকটা সফলভাবে। এটি সম্ভব হয়েছিল জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনের কারণে। আমার মনে হয়, এখন সড়কে আবার যদি ওরা নামে, তবে একই রকম আনুকূল্য হয়তো পাবে না। অতি সম্প্রতি বড় মারামারি হয়ে গেল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও বিএম কলেজের ছাত্রদের মধ্যে। এই মহারণে যারা অংশ নিয়েছে, তারাই দুই দিন আগে গণ-আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ছিল। আন্দোলনের সমন্বয়কদের নামও পাওয়া যায়, যদিও কোনো কোনো কাগজ লিখেছে ওরা মধ্যস্থতা করতে গিয়েছিল। আবার প্রত্যক্ষদর্শী অনেকে বিরূপ মন্তব্যও করেছে।

প্রথম দিকে নানা অঞ্চলে চাঁদাবাজদের উত্থান ঘটতে শুরু করায় শিক্ষার্থীদের সফল প্রতিরোধ আমরা লক্ষ করেছি। এই কয়েক দিনের ব্যবধানেই এখন নানা অঞ্চলে বিএনপি-ছাত্রদলের নামে চাঁদাবাজ ও দখলদারদের দৌরাত্ম্য শুরু হয়ে গেছে, যে কারণে বিএনপি নেতারা দলীয় চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে বারবার সাবধান বাণী উচ্চারণ করছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের তেমন সংঘশক্তি এখন আর দেখতে পাচ্ছি না। ওরা আর ঝাঁপিয়ে পড়ছে না চাঁদাবাজদের দমন করতে।

এবারের গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে তারুণ্যের শক্তি আমরা আবিষ্কার করলাম, তা ছিল অভিনব। এই শক্তিকে আমরা সম্পদ হিসেবেই মনে করি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ৪০ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে যা দেখিনি, তা এখন দেখতে হচ্ছে। বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শিক্ষা ও গবেষণার পীঠস্থান নয়, বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে একটি সাংস্কৃতিক বলয়ও গড়ে ওঠে। এই অঞ্চলে শিক্ষার্থী-শিক্ষক সবার চলায়-বলায় একটি মার্জিত রূপ সবাই প্রত্যাশা করবে। কিন্তু এবারের আন্দোলনোত্তর সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো কোনো শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও ক্যাম্পাসবাসী অনেকের বিরুদ্ধে যে ভাষায় ট্রল করছে, তা দেখে ও পড়ে লজ্জায় অধোবদন হতে হয়। শুধু শিক্ষার্থী কেন, এসব অসংস্কৃত আচরণ কোনো কোনো শিক্ষকও করে যাচ্ছেন ভিন্ন উদ্দেশ্যে।

সম্প্রতি একটি ঘটনার কথা বলছিলেন একজন স্নেহভাজন সহকর্মী। কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের কথা। এই নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ মানুষ। আন্দোলনের সময় এক শিক্ষার্থী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্যারকে অপমানসূচক বাক্যে নিন্দা করলেন। শিক্ষকের অপরাধ গুরুতর নয়। আন্দোলনের সময় তিনি তাঁর নিকটাত্মীয়র ছেলের বিয়েতে নিমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলেন। বিষয়টি ছিল একান্তই ব্যক্তিগত। এ পর্যন্ত বিষয়টি নিষ্পত্তি হলে একরকম ছিল। কিন্তু আমার সহকর্মী বিস্মিত হয়েছেন, যখন দেখেন একজন অধ্যাপিকা আলাপ প্রসঙ্গে বলছিলেন এই আন্দোলনের সময় অমুক স্যারের অবস্থান বিতর্কিত ছিল। এমন অদ্ভুত মন্তব্যের পর কারণ জানতে চাওয়ায় অধ্যাপিকা বললেন, ফেসবুকে দেখেছেন আন্দোলনের সময় তিনি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। আমার সহকর্মী হাসতে হাসতে বললেন, এই অধ্যাপিকার বক্তব্য শুনে সেই প্রচলিত কথাটি মনে হলো, ‘নওমুসলিম গরু খাওয়ার যম’। কারণ ছাত্র আন্দোলনের শুরুতে তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পক্ষে ছিলেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের একটি ক্ষোভ ছিল, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়ায়। গণজোয়ার শুরু হলে সময়মতো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষে এসে দাঁড়ান। এখন এসব বলে তিনি নাকি বেশি বেশি শিক্ষার্থীবান্ধব হতে চাইছেন। এভাবে আমরা সভ্যতা-ভব্যতা ও মূল্যবোধ যদি খোয়াতে থাকি, তাহলে ভবিষ্যৎ তো আলোকিত হতে পারে না।

আশার কথা, আন্দোলনের মাঠে থাকা বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে দেখলাম, তারা শিক্ষকদের অপমান করাকে পছন্দ করছে না। একজন ছাত্রীর দায়িত্বশীল বক্তব্য ভালো লাগল। বলছিল, ‘আমরা অনেক রক্তের বিনিময়ে এক দফা আদায় করেছি। স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছি। এখন আমরা আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে গেছি। শিক্ষাজীবন শেষ করাটা আমাদের আসল কাজ। সরকার ও দেশের মানুষ দেশকে এগিয়ে নেবে। দেশ যদি আবার কখনো সংকটে পড়ে, আমরা আবার ঝাঁপিয়ে পড়ব। ’

আমাদের মনে হয়, তারুণ্যের এই শক্তি ও আবেগকে ধরে রাখা আমাদের দায়িত্ব। এ কারণে আমাদের আবেদন থাকবে কোনো পক্ষই যাতে শিক্ষার্থীদের অন্যায় কাজে উসকে না দেয়, যা তাদের বিতর্কিত করবে। জানাতে হবে আন্দোলনেরও অনেক ভাষা রয়েছে। ছাত্র ও শিক্ষকরা জ্ঞানচর্চার সঙ্গে জড়িত। কোনো অযৌক্তিক প্রতিক্রিয়া তাদের জন্য মানানসই হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সতর্ক থাকতে হবে, যাতে আবার কোনো রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রভু হয়ে না বসতে পারে। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির রামরাজত্ব ফিরিয়ে আনতে না পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের নেতৃত্ব বহাল হোক।

লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

shahnawaz7b@gmail.com

news24bd.tv/আইএএম