অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষাখাতে যত চ্যালেঞ্জ

ফাইল ছবি

অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষাখাতে যত চ্যালেঞ্জ

নিজস্ব প্রতিবেদক

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনেক বেশি। এই সরকারের সামনে রয়েছে আবার অনেক চ্যালেঞ্জ। তার মধ্যে শিক্ষা খাত একটি। শিক্ষা খাত বাংলাদেশের দুর্বলতম খাতগুলোর অন্যতম।


প্রবাদ আছে, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা আবার বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যেমন- নৈতিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ইত্যাদি। নৈতিক শিক্ষার অবক্ষয়ের কারণে 
যেমন সমাজে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিক তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্রমেই অবনতি হচ্ছে।
বিগত আমলে দেশে সাক্ষরতার হার বাড়লেও প্রত্যাশা অনুযায়ী মিলেনি চাকরি। চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগছে তরুণ-তরুণীরা। এর জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষার ঘাটতিকে দায়ী করছেন শিক্ষাবিদরা। দেশে মানসম্পন্ন শিক্ষার ঘাটতি রয়েছে বলে শিক্ষাবিদরা বলে আসছেন আগে থেকেই। বর্তমানে দেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এই বেকাররা চাকরি না পেয়ে হয়েছেন অবহেলিত।   এই সরকারের সামনে এখন অনেক চ্যালেঞ্জ। তার মধ্যে শিক্ষা খাত বাংলাদেশের দুর্বলতম খাতগুলোর অন্যতম।  

শিক্ষার ক্ষেত্রেও সংস্কার ও পরিবর্তনের প্রত্যাশা বিস্তর ও বহুমুখী। শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ তলানিতে। বিগত বছগুলোতে কয়েক দিন পরপর শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে কাটাছেঁড়া চলেছে। শিক্ষার নিন্মমান, দলীয় পরিচয়ে অযোগ্য-অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষা বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং ব্যবসায়, ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি, কারিগরি শিক্ষার অপ্রতুলতা ইত্যাদি সমস্যার কারণে শিক্ষার মান ক্রমাগত নিম্নমুখী। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর শিক্ষাক্ষেত্রে প্রথম ধাপে কিছু পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে-

পুরোনো সিলেবাসে ফিরে যাওয়া:
অভিভাবকদের তীব্র প্রতিবাদে ১ সেপ্টেম্বর নতুন শিক্ষাক্রম বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ২০২৩ সাল থেকে বাস্তবায়ন শুরু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রম। ওই বছর তিন শ্রেণিতে বাস্তবায়ন করা হয়। চলতি বছর আরও নতুন চার শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন চলছে। এ শিক্ষাপদ্ধতি বাস্তবায়নে নানা অসংগতি ও অভিভাবকমহলে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়।

তাই এই শিক্ষাবর্ষের নয় মাসের মাথায় এসে ওই কারিকুলাম বাস্তবায়ন বন্ধ করে ডিসেম্বরে আগের নিয়মে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির এক কোটি শিক্ষার্থীর বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নযোগ্য না হলেও পাঠ্যবই চলতি বছরের জন্য বহালই থাকবে। ফলে নতুন শিক্ষাক্রমের বই থেকেই কী উপায়ে পুরোনো স্টাইলে বার্ষিক পরীক্ষা হবে, তা বের করতে কাজ করছে এনসিটিবি।

অসমাপ্ত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল:
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর তাৎক্ষণিক বহু সমস্যা দেখা দিয়েছে। এবং অতীতে আরও দেখা দিতে পারে। সচিবালয়ে ছাত্রদের অবরোধ ও দাবির মুখে অসমাপ্ত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ভিন্নভাবে ফলাফল প্রকাশ করা হবে বলেও জানানো হয়। তবে ছাত্রদের অবরোধ ও দাবির মুখে পরীক্ষা বাতিল নিয়েও সমালোচনার মুখে পড়তে হয় এই সরকারকে।

শিক্ষা ক্ষেত্রে এই সরকারের যত চ্যালেঞ্জ
গত দেড় দশক শিক্ষার আশানুরূপ ফলাফল কিছুই দেখা যায়নি। আধিপত্য ও আনুগত্যের রাজনীতির প্রভাবে ও যোগ্য শিক্ষা-নেতৃত্বের অভাব দেখা গেছে। যার ফলাফল গত দেড় দশকে শিক্ষাক্রম পদ্ধতি নিয়ে বরং বিতর্ক তৈরি হয়েছে বিভিন্ন সময়ে।
২০১০ সালে একটি জনসমর্থিত জাতীয় শিক্ষানীতি গৃহীত হয়েছিল। দেশের শিক্ষা উন্নয়নের রূপরেখা দেওয়া হয়েছিল এ নীতিতে। কিন্তু ১৪ বছর ধরে এ নীতি বাস্তবায়নে কোনো সামগ্রিক ও সমন্বিত উদ্যোগ দেখা যায়নি।  
শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ও সুবিধা বাড়াতে হবে  
শেখ হাসিনা আমলের সরকার শিক্ষায় কৃতিত্বের অংশ হিসেবে বলে এসেছেন যেমন- কন্যাশিশুসহ শিক্ষার্থীসংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকসংখ্যা বেড়েছে, বহুসংখ্যক শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া হয়েছে, সব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক দেওয়া হয়েছে, বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ তৈরি করা হয়েছে ইত্যাদি।

কিন্তু এসব পদক্ষেপ থেকে শিক্ষার অর্জনে যে ফল পাওয়ার কথা, তা পাওয়া যায়নি মূলত ওপরে উল্লেখিত নানা দুর্বলতার কারণে। সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল একটি সামগ্রিক শিক্ষা উন্নয়নের রূপরেখা অনুসরণ না করা ও যথেষ্টসংখ্যক পেশাগত দক্ষতাসম্পন্ন নিবেদিত শিক্ষকের অভাব। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষার উন্নয়নে দরকার বাজেটের কমপক্ষে ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া। এছাড়া শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতি বন্ধ করা, মেধাবীদের মূল্যায়ন করা, যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, মেধা পাচার বন্ধ, ব্যবসায়িক শিক্ষার প্রসার, নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা আবশ্যক করা, সত্যিকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে অগ্রাধিকার দেয়া। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন দলের পরামর্শে শিক্ষা, সিলেবাস, দলীয় বিষয় অন্তর্ভুুক্তি আইনের মাধ্যেমে বন্ধ করা। পাশাপাশি গবেষণা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, শিক্ষকদের ট্রেনিং, আধুনিক অবকাঠামো বৃদ্ধি, প্রয়োজনে অনলাইন ক্লাস চালু করা, প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়ন করা। এছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ফ্রি স্কুল মিল চালু করা, বিনামূল্যে কলেজ পর্যন্ত ফ্রি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা, টিচিং স্ট্যান্ডার্ড মেনটেন করা, কিন্ডারগার্টেন, কারিগরি শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা, আবার মাদরাসার মধ্যে কওমি, আলিয়া, ইবতেদায়ি ইত্যাদির মধ্যে সমন্বয় সাধন করা দরকার।

রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে একটা বড় ধরনের সংস্কার খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর শিক্ষার্থীরা দাবি জানিয়ে আসছেন রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গন চান তারা। প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দলীয় রাজনীতিমুক্ত করার পদক্ষেপ নিতে হবে। তা ছাড়া অনেক দিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হল-বাণিজ্য শুরু হয়েছে। দলীয় রাজনীতির কারণে মেধাবীরা পড়াশোনার পরিবর্তে নানা রকম বাণিজ্যের মধ্যে পড়ে গেছে।  
news24bd.tv/ডিডি