লিটন চৌধুরীর চাপে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য কিনতে হয় ৯০০ কোটি টাকার জমিন

লিটন চৌধুরীর চাপে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য কিনতে হয় ৯০০ কোটি টাকার জমিন

অনলাইন ডেস্ক

নদীশাসনের জন্য তোলা বালু ফেলতে পদ্মা সেতু প্রকল্পে কেনা হয়েছিল ৯০০ কোটি টাকার জমি। সেই জমির বড় অংশ নদীর পানিতেই বিলীন হয়ে গেছে। এখনো ভাঙন চলছে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে থাকা দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, তখন জমিগুলো কেনার কোনো প্রয়োজন ছিল না।

কিনতে হয়েছে সাবেক চিফ হুইপ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাইয়ের ছেলে নূরে আলম চৌধুরীর (লিটন চৌধুরী নামে পরিচিত) কৌশল ও চাপে। তখন আন্দোলন করে জমি কিনতে বাধ্য করা হয়।

এ ব্যাপারে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, ওই জমির একাংশের ভুয়া মালিক সাজিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। কারণ, চরের জমির কোনো মালিক আসলে ছিলেন না; ছিল খাসজমি।

জমির কোনো কোনো প্রকৃত মালিককে ক্ষতিপূরণের টাকার একাংশ দিয়ে বাকিটা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের তৎকালীন পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম এক গণমাধ্যমকে বলেন, নদীশাসনের জন্য ছয়–সাত কোটি ঘনমিটার বালু তোলা হয়। এর বেশির ভাগই মাদারীপুরের চরে ফেলা হয়েছে। মাদারীপুরে চরের জমি অধিগ্রহণ করতে হলেও শরীয়তপুরে স্থানীয় কৃষকদের কিছু ক্ষতিপূরণ দিয়ে জমিতে বালু ফেলা হয়েছে। তিনি বলেন, সরকারের উচ্চপর্যায়ের অনুমতি নিয়ে জমি কেনার সিদ্ধান্ত হয়।

স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, ওই জমির একাংশের ভুয়া মালিক সাজিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। কারণ, চরের জমির কোনো মালিক আসলে ছিলেন না; ছিল খাসজমি। জমির কোনো কোনো প্রকৃত মালিককে ক্ষতিপূরণের টাকার একাংশ দিয়ে বাকিটা আত্মসাৎ করা হয়েছে।

পদ্মা সেতু প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, শরীয়তপুরের চরে স্থানীয় লোকজনকে ৩৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে বালু ফেলা হয়েছিল। মাদারীপুরেও একই প্রক্রিয়ায় বালু ফেলা শুরু হয়; কিন্তু লিটন চৌধুরীর অনুসারী স্থানীয় কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কৃষকদের খেপিয়ে তোলেন। তারা জমি অধিগ্রহণ করে বালু ফেলার জন্য চাপ দেন। উল্লেখ্য, সরকারিভাবে জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে দামের তিন গুণ ক্ষতিপূরণের আইন পাস হয় ২০১৭ সালে।

স্থানীয় লোকজনের বাধায় নদীশাসনের কাজ বন্ধ হয়ে গেলে বিষয়টি তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে জানানো হয়। তিনি তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতামত নেন। লিটন চৌধুরীই স্থানীয় লোকজনের বিক্ষোভের পেছনে রয়েছেন, সেটিও তুলে ধরা হয়। সেতু বিভাগ সূত্র জানায়, বিষয়টি শুনে শেখ হাসিনা জমি কিনে ফেলার নির্দেশনা দেন। শেষ পর্যন্ত বাড়তি জমি কেনা বাবদ ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা যুক্ত করে বিশেষভাবে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করা হয়। ২০১৬ সাল থেকে পরের কয়েক বছরে ৯৬৪ হেক্টর চরের জমি কেনা হয়।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর লিটন চৌধুরী আত্মগোপনে চলে গেছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বালু ফেলার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে আন্দোলনে নামিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে নেপথ্যে ছিলেন শিবচর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আতাহার ব্যাপারী, কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সোহেল ব্যাপারী, চরজানাজাত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রায়হান সরকার, মাতবরেরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফজলুল হক মুন্সি এবং সাবেক চেয়ারম্যান মাহমুদ চৌধুরী। তারা আত্মগোপনে রয়েছেন।

কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহার ব্যাপারীও আত্মগোপনে রয়েছেন। তিনি মুঠোফোনে গণমাধ্যমকে জানান, প্রথমে সেতু কর্তৃপক্ষ চরের জমি বালু ফেলার জন্য ইজারা নিতে চেয়েছিল। তারা দুই দফা ইজারার টাকাও দিয়েছিল। তিনি বলেন, জমি ভাঙনের কবলে পড়তে পারে এবং ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা হারাতে পারে, এমনটা ভেবে তারা বালু ফেলতে বাধা দেন। তখন লিটন চৌধুরীর মধ্যস্থতায় সেতু বিভাগ জমি অধিগ্রহণ করতে রাজি হয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, বালু ফেলার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে আন্দোলনে নামিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে নেপথ্যে ছিলেন শিবচর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আতাহার ব্যাপারী, কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সোহেল ব্যাপারী, চরজানাজাত ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রায়হান সরকার, মাতবরেরচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফজলুল হক মুন্সি এবং সাবেক চেয়ারম্যান মাহমুদ চৌধুরী। তারা আত্মগোপনে রয়েছেন।

টাকা ‘ভাগ-বাঁটোয়ারা’ বালু ফেলার জন্য যে চরের জমি অধিগ্রহণ করা হয়, তা পদ্মা নদীর মধ্যে। অবস্থান পদ্মা সেতুর উজানে পূর্ব দিকে শিবচরের কাঁঠালবাড়ী, চরজানাজাত ও মাতবরেরচর ইউনিয়নের মধ্যে। অধিগ্রহণ করা জমিতে কিছু মানুষের অস্থায়ী বসবাস ছিল। স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, চরের অধিকাংশ জমি সরকারের খাস খতিয়ানভুক্ত। কেউ বন্দোবস্ত নিয়ে চাষাবাদ করছিলেন, কেউ দখল করে চাষাবাদ করছিলেন। যখনই সরকারিভাবে বালু ফেলার সিদ্ধান্ত হয়, তখনই জমির নিয়ন্ত্রণ নেন লিটন চৌধুরীর অনুসারীরা। তারা বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তোলেন, যাতে বেশি ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়।

চরের জমিগুলো যাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, তারা খাসজমির ভুয়া মালিক সাজিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২০২১ সালে মাদারীপুরের তৎকালীন ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা প্রমথ রঞ্জন ঘটক পাঁচ ব্যক্তিকে ৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকার চেক দেন। মাগুরখণ্ড মৌজার যে জমির মূল্য বাবদ এ টাকা দেওয়া হয়েছিল, তা ওই ব্যক্তিদের নয়। ওই জমি ছিল খাস সম্পত্তি। ওই ঘটনা জানাজানি হলে তদন্তের পর গত ৪ এপ্রিল প্রমথ রঞ্জন ঘটককে জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব থেকে পদাবনতি দিয়ে সহকারী সচিব করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া জমি অধিগ্রহণের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মাদারীপুর জেলা প্রশাসনের সাবেক সার্ভেয়ার মোস্তাফিজুর রহমান ও তার সহযোগী রুবেল হাওলাদারের বিরুদ্ধে গত ফেব্রুয়ারিতে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

জমির প্রকৃত মালিকদের কাছ থেকে ‘খরচের’ কথা বলে টাকা নেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। দক্ষিণ চরজানাজাতের বাসিন্দা নুরু ব্যাপারীর পরিবারের সাড়ে তিন বিঘা জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, বিঘাপ্রতি ১০ লাখ টাকা দামে আড়াই বিঘা জমির টাকা তিনি পেয়েছেন। স্থানীয় এক প্রভাবশালী ব্যক্তির মাধ্যমে জমির টাকা তিনি উত্তোলন করেন। টাকার একটি বড় অংশ ওই প্রভাবশালী ‘খরচ আছে’ বলে নিয়ে গেছেন। তবে তিনি ওই প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম বলতে রাজি হননি।

জমি অধিগ্রহণের সময় মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন ওয়াহিদুল ইসলাম। বক্তব্য জানতে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করে সাড়া পাওয়া যায়নি। ওয়াহিদুলের বদলির পর জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পান রহিমা খাতুন। সূত্রের দাবি, তিনি দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে ২০২২ সালে অধিগ্রহণের টাকার একটি অংশ পরিশোধ করার প্রক্রিয়া আটকে দেন। যদিও তিনি আসার আগেই ৯৫ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করা হয়েছিল।

অধিগ্রহণ করা জমিতে বালু ফেলার পর তা কী করা হবে, সেটি নিয়ে সিদ্ধান্ত ছিল না। সেতু বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, জমিগুলো নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে একাধিক বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত থাকা একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে বলেন, জমিগুলোতে শেখ হাসিনা সরকার একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার পরিকল্পনা নেয়। যদিও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বিশেষজ্ঞরা জানিয়ে দেন, চরের মাটিতে বিমানবন্দর করা সম্ভব নয়।

পরে জমিগুলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয় গবাদিপশুর খামার ও শুটিং স্পট করার লক্ষ্যে। ২০১৯ সালের অক্টোবরে সেতু বিভাগ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়। শিবচরের চরজানাজাত, কাঁঠালবাড়ী ও মাদবরেরচর গত মঙ্গলবার ঘুরে এবং স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধিগ্রহণ করা জমির ৬০ শতাংশের মতো নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। চর এখনো ভাঙছে।

চরজানাজাত এলাকায় সেনাবাহিনীর গরুর একটি খামার রয়েছে। সেখানে প্রায় আড়াই শ গরু পালন করা হয়। স্থানীয় লোকজনের দাবি, ৯০০ কোটি টাকার জমি কেনা নিয়ে দুদক অনুসন্ধান চালালেই বেরিয়ে আসবে, কে কত টাকা পেয়েছে। কতটা খাসজমির ভুয়া মালিক সাজিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত জুনে প্রকল্পটি সমাপ্ত করা হয়। ব্যয় হয় মোট ৩০ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা। ২০০৭ সালে যখন পদ্মা সেতু প্রকল্প নেওয়া হয়, তখন ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা।

স্থানীয় লোকজনের দাবি, ৯০০ কোটি টাকার জমি কেনা নিয়ে দুদক অনুসন্ধান চালালেই বেরিয়ে আসবে, কে কত টাকা পেয়েছে। কতটা খাসজমির ভুয়া মালিক সাজিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। মাদারীপুরের শিবচরের মাদবরেরচর এলাকার কৃষক আবদুল বারেক গণমাধ্যমকে বলেন, চরের জমি অধিগ্রহণের টাকা কোথায় গেছে, তা নিয়ে তদন্ত করা দরকার।

news24bd.tv/SC