আওয়ামীপন্থি ডিসি নিয়োগ, বেকায়দায় অন্তর্বর্তী সরকার

সচিবালয়ে ডিসি নিয়োগ নিয়ে ঘটে হাতাহাতির ঘটনা। ছবিটি গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ের ভেতরের।

আওয়ামীপন্থি ডিসি নিয়োগ, বেকায়দায় অন্তর্বর্তী সরকার

নিজস্ব প্রতিবেদক

শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস পেরিয়েছে গত ৮ সেপ্টেম্বর। এ সময়টাতে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের মনোযোগ প্রশাসন ঢেলে সাজানোতে। চলছে একের পর এক রদবলদ। অনেককে পাঠানো হচ্ছে বাধ্যতামূলক অবসরে।

 

আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত সাড়ে ১৫ বছর প্রশাসনে যারা তাদের সহচর হিসেবে কাজ করেছে, হাসিনা সরকারকে যারা দানবে পরিণত করেছে, মূলত তাদের বাদ দিয়েই ক্লিন ইমেজের কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা বা পদ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগের বেলায় বেকায়দায় পড়লো অন্তর্বর্তী সরকার।

গত সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) ২৫ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসন বা ডিসি নিয়োগ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপর গতকাল (১০ সেপ্টেম্বর) আরও ৩৪ জেলায় দেওয়া হয় নতুন ডিসি নিয়োগ।

নিয়োগপ্রাপ্ত ডিসিদের নাম প্রকাশের পরেই সচিবালয় জুড়ে শুরু হয় অস্থিরতা। ডিসি হিসেবে একসময়ের বড়মাপের ছাত্রলীগ নেতারা সুযোগ পাওয়া বিতর্ক উসকে দেয়।

এই বিতর্কের মুখে পড়ে দায়িত্ব পাওয়ার ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই সিলেটের ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া পি কে এম এনামুল করিমকে প্রত্যাহার করে নেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এখানেই শেষ নয়, এরপর একে একে বেরিয়ে আসতে থাকে আরও অনেকের নাম, যারা গত সাড়ে ১৫ বছর নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে গেছেন আওয়ামী লীগ সরকারকে।

আরও পড়ুন: ২৫ জেলায় নতুন ডিসি

আরও পড়ুন: আরও ৩৪ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ

দুদিনে দেশের ৫৯ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগের পর বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ তুলে গতকাল মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হট্টগোল করেন উপ-সচিব পর্যায়ের একদল কর্মকর্তা। এদিন দুপুরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব কে. এম. আলী আযম ও জিয়াউদ্দিনের কক্ষে হট্টগোল করেন তারা। বেলা ৩টায় বঞ্চিত কর্মকর্তারা এ দুই যুগ্ম সচিবের কক্ষ অবরুদ্ধ করে রাখেন। কর্মকর্তাদের রোষ থেকে নিজেকে বাঁচাতে যুগ্ম সচিব আলী আযম পাশের রুমের টয়লেটে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেন। প্রায় ২ ঘণ্টা পর সিনিয়র কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে তাকে বের করে আনেন।

জেলা প্রশাসক পোস্টিংয়ে বঞ্চিতরা আজ বুধবারও (১১ সেপ্টেম্বর) সকাল থেকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এসে জড়ো হয়েছেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ও মাঠ প্রশাসনের অধিশাখার যুগ্মসচিব মোহাম্মদ খোরশেদ আলমের রুমে বৈঠক করছেন তারা।

বিসিএস ২৪, ২৫ ও ২৭ ব্যাচের ডেপুটি সেক্রেটারি যারা আছেন, এমন ৯০ থেকে ১০০ জনের মত মনে করছেন ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বরের ডিসির তালিকায় তাদের থাকার কথা ছিল। কিন্তু তারা বঞ্চিত হয়েছে। যারপরনাই নতুন করে জেলা প্রশাসকের তালিকা করার দাবি তাদের।


দায়ী করা হচ্ছে যাদের 

ডিসি নিয়োগে এমন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির জন্য বঞ্চিতরা দাবি করছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দপ্তরবিহীন উপদেষ্টা সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারকে। তাদের অভিযোগ, আলী ইমাম মজুমদারের পছন্দেই আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাঠ প্রশাসনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাচ্ছেন।

এ কাজে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মহাপরিচালক অতিরিক্ত সচিব আহসান কিবরিয়াও জড়িত। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিতি রয়েছে আহসানের। এমন কর্মকর্তাদের হাতে প্রশাসন সাজানোর ক্ষমতা দেওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে বলেও মনে করেন ডিসি নিয়োগে বঞ্চিত কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন: ডিসি হলেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা, বিএনপিপন্থী আমলাদের মধ্যে ক্ষোভ

যাদের নিয়ে আপত্তি

অভিযোগ উঠেছে, দুদিনে নিয়োগ পাওয়া ৫৯ ডিসির মধ্যে বেশির ভাগ কর্মকর্তা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এবং সাবেক মন্ত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। কয়েকজনের শেয়ারবাজারে মোটা অংকের বিনিয়োগ রয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে সহকর্মীকে হেনস্তা করার অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া কয়েকজনের মাঠ প্রশাসনে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই।

নতুন ডিসিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার বিগত সরকারের সময়ে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধাভোগীরাও ডিসি পদ বাগিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগবঞ্চিত কর্মকর্তাদের।

গত সোমবারের প্রজ্ঞাপনে যেসব কর্মকর্তার নাম রয়েছে, তাদের মধ্যে ফরিদপুরের ডিসি মোহাম্মদ কামরুল হাসান মোল্যা আওয়ামী আমলে ঢাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা সাভারের ইউএনও ছিলেন। তিনি বর্তমানে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে কর্মরত। বিগত সরকারের আস্থাভাজন হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে কাজ করছেন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ফারহানা ইসলামকে কুষ্টিয়ার ডিসি করা হয়েছে। তিনি নরসিংদী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে থাকার সময় তৎকালীন ডিসি জিল্লার রহমানের ‘ঘনিষ্ঠজন’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর সঙ্গেও তার বন্ধুত্ব রয়েছে। সে সুবাদে তিনি গাজী টেলিভিশনে সংবাদও পাঠ করেন। দীর্ঘদিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আছেন ফারহানা।

২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা চাঁদপুরের ডিসি মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিনকে চলতি বছরের ২৭ মার্চ রংপুরের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে পদায়ন করে আওয়ামী লীগের সরকার। এর পরও তাকে বর্তমান প্রশাসন ডিসি করেছে। এ নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন: জনপ্রশাসনে হাতাহাতি, বাতিল হতে পারে ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন

নাটোরের ডিসি রাজীব কুমার সরকার আওয়ামী লীগের কট্টর সমর্থক হিসেবে পরিচিত। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরীর কাছের লোক হিসেবে পরিচিত রাজীব সংস্কৃতি সচিব খলিল আহমেদের পিএস (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ছিলেন।

শেরপুরের ডিসি তরফদার মাহমুদুর রহমান সাবেক আইন বিচার ও লেজিসলেটিভ সচিব মইনুল কবিরের একান্ত সচিব (পিএস)। তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ।

জয়পুরহাটের ডিসি সাইদুজ্জামান ‘বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কের’ পিডি ছিলেন। ঢাকায় এসিল্যান্ড থাকাকালে দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি। নোয়াখালীর নতুন ডিসি খন্দকার ইশতিয়াক দীর্ঘদিন থেকে মন্ত্রিপরিষদে কর্মরত। তিনি আওয়ামী পরিবারের সদস্য এবং সরাসরি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

রাজশাহীর ডিসি নিয়োগ পাওয়া মো. মাহবুবুর রহমান ছিলেন সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমদের ঘনিষ্ঠজন। সমাজসেবা অধিদপ্তরের একটি নিয়োগে নিজের পছন্দ অনুযায়ী লোক নিয়োগ দিতে এই মাহবুবুরকে নিয়োগ কমিটির সদস্য করেছিলেন নুরুজ্জামান।

এদিকে সমালোচনার মুখে সিলেটের ডিসি নিয়োগ পাওয়া পি কে এম এনামুল করিমের আদেশ বাতিল করেছে সরকার। তার পরিবর্তে সেখানে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

গত সোমবার ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারির পর ফেনীর সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) এনামুল করিমের নিয়োগ নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এনামুল করিম ২০১৯ সালে ফেনীর নুসরাত হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের বাঁচাতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালান বলে অভিযোগ রয়েছে। মৃত্যুর আগে নুসরাত জাহান রাফি ও তার মা শিরিন আক্তার ন্যায়বিচারের আশায় তার কাছে গিয়েছিলেন। এরপর এনামুল করিমের বিরুদ্ধে মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগ ওঠে।  


যা হতে পারে 

দেশ সংস্কারের অংশ হিসেবে অন্তর্বর্তী সরকার যখন পুরো প্রশাসন ঢেলে সাজানোর কাজ করছে, তখন ডিসি নিয়োগে এমন অভিযোগ বিব্রতকর অবস্থাতেই ফেলে দিলো সরকারকে। সচিবালয়ে হট্টগোলের আর চারদিকে তীব্র সমালোচনায় যেকোনো সময় ডিসি নিয়োগের দুই প্রজ্ঞাপন বাতিলও হতে পারে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আজ বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সদ্য নিয়োগ পাওয়া ডিসিদের একটি ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। সেটি অনিবার্য কারণবশত স্থগিত করা হয়েছে। এজন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ডিসিদের পদায়ন হওয়া কর্মস্থলের উদ্দেশে যাত্রা করতেও বারণ করা হয়েছে।

news24bd.tv/SHS