প্রশাসন, তুমি কোথায়?

মোফাজ্জল করিম

প্রশাসন, তুমি কোথায়?

মোফাজ্জল করিম

আবার নজরুল! গত লেখাটিও শুরু করেছিলাম জাতীয় কবির চরণ উদ্ধৃত করে। এবারও তাই। নজরুলের একটি সুন্দর জাগরণী সংগীত আছে—একটি ইসলামী সংগীত। ‘দিকে দিকে পুনঃ জ্বলিয়া উঠেছে দীন-ই-ইসলামী লাল মশাল/ওরে বে-খবর তুইও ওঠ জেগে, তুইও তোর প্রাণ-প্রদীপ জ্বাল’।

এবারের লেখাটির সূচনাতে সেই সংগীতের উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক হবে মনে করি।

দেশে গত কদিন ধরে যে জাগরণী-হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে, এর ভেতর আমাদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শ্রেণিকে আমার কাছে কেন জানি মনে হচ্ছে ‘বে-খবর’। তারা কারা? তারা আমাদের জনপ্রশাসনের তথাকথিত ‘এলিট’ শ্রেণি প্রশাসকরা। যেহেতু চাকরিজীবনের প্রায় চার দশক নানাভাবে প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম তাই এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমার অনুজপ্রতিম বর্তমান প্রজন্মের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমার অনুভূতিগুলো শেয়ার করার তাগিদ অনুভব করছি।

২.
দেশের প্রশাসনে কর্তব্যরত ব্যক্তিদের মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায় : শীর্ষ পর্যায়ে (কেন্দ্রে) অবস্থানকারী নীতিনির্ধারকগণ ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ। একটি গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সরকার গঠন করেন। আর বেতনভুক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তায় রাষ্ট্র পরিচালনা করেন সরকার। কেন্দ্রে অবস্থানকারী সরকারের সিদ্ধান্তগুলো আদেশ-নির্দেশ-নীতিমালার আকারে প্রেরিত হয় মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বপালনকারী সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে।

কর্মকর্তারা দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনকানুন মেনে সেইসব আদেশ-নির্দেশ বাস্তবায়ন করেন। কেন্দ্রে ও মাঠ পর্যায়ে নিয়োজিত সব কর্মকর্তা-কর্মচারী হচ্ছেন দেশের সিভিল সার্ভিস বা বেসামরিক প্রশাসনের সদস্য। বিভিন্ন বিভাগ, যেমন সাধারণ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ইত্যাদি স্ব স্ব কাঠামোর মাধ্যমে জনসাধারণকে সেবাপ্রদান করে থাকে।

৩.

আবহমানকাল ধরে যে বিভাগটি মাঠ পর্যায়ে ‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত প্রায় সব ধরনের সেবাপ্রদানের সঙ্গে কমবেশি জড়িত তার নাম জনপ্রশাসন। কোথাও মহামারীতে প্রাণহানি হচ্ছে, কিংবা কোথাও দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব, বন্যায় বা খরায় হয়েছে শস্যহানি, সাইক্লোনে উড়ে গেছে ঘরবাড়ি—এ রকম যেকোনো পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট এলাকার আস্থার প্রতীক প্রশাসনের কর্মকর্তাকে সবার আগে জবাবদিহি করতে হয় সরকারের কাছে।

আর উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে প্রশাসন, তুমি কোথায়?পড়তে হয় প্রশাসনের এই কর্তাব্যক্তিটিকে। জেলা প্রশাসনের এই শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিটির পদবী জেলা প্রশাসক, ইংরেজিতে ডেপুটি কমিশনার (ডি.সি.)। উপজেলায় তাঁকে বলা হয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সংক্ষেপে ইউএনও। ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা জেলা প্রশাসনের মৌলিক দায়িত্ব হলেও সব ধরনের উন্নয়ন কার্যক্রম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিচালনা, খেলাধুলার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি প্রায় সব ধরনের কর্মকাণ্ডে জনপ্রশাসনের এই কর্তাব্যক্তিটিকে নেতৃত্ব দিতে হয়। ফলে তাঁর এলাকায় ডি.সি. বা ইউএনও যথার্থই সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী কর্মকর্তা। মাঠ প্রশাসনের এরূপ ব্যবস্থাপনা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। ব্রিটিশ আমলে (১৭৫৭-১৯৪৭) সাধারণ মানুষ এই দাপুটে জেলাধিপতিকে সম্বোধন করত ‘হুজুর মাই বাপ’ বলে। তাদের কাছে তিনি যেমন ছিলেন দণ্ডমুণ্ডের মালিক তেমনি ছিলেন ন্যায়বিচারের প্রতিভূ। সরকার তার ভালো-মন্দ সব কার্য সম্পাদনের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিলেন এই কর্মকর্তাটির ওপর। কালের বিবর্তনে যদিও তাঁর দায়িত্ব ও সেই সঙ্গে ক্ষমতা অনেকখানি সংকুচিত হয়ে গেছে তবুও এখনো ডি.সি. বা ইউএনও স্ব স্ব এলাকায় প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তি বটেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না মাঠ প্রশাসনের এই শীর্ষ কর্মকর্তাদের নেতৃত্বের ওপর একটি সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা অনেকখানি নির্ভরশীল। ছলে-বলে-কৌশলে লাগাতার ১৫ বছর শাসনক্ষমতা আঁকড়ে থাকা সরকারের পদত্যাগের ভেতর দিয়ে গত ৫ আগস্ট যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হলো তার সুফল নির্যাতিত, বঞ্চিত, হতাশাগ্রস্ত মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছাতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি নিরপেক্ষ, নিবেদিতপ্রাণ, নির্লোভ মাঠ প্রশাসনের। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখতে পেলাম? ছাত্র-জনতার পাশে সেনাবাহিনী ঠিকই দাঁড়িয়েছে, এমন কি ক্লান্ত বিমর্ষ পুলিশও গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়েছে, কিন্তু জনপ্রশাসন যেন নিখোঁজ। যেন মনোবল হারানো একটি সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আলো-আঁধারিতে অধোবদনে দাঁড়িয়ে আছে গৃহকোণে।

৪.

এ পর্যন্ত লেখার পর হাতে এলো (১৪ আগস্ট বুধবার) দৈনিক কালের কণ্ঠ। পত্রিকাটির ১১ পৃষ্ঠায় ‘মেধাভিত্তিক নিরপেক্ষ ও দক্ষ প্রশাসনিক কাঠামোর ৯ দাবি’ শীর্ষক তিন কলামের প্রতিবেদনটি পড়ে প্রথমেই বললাম ‘আলহামদুল্লািহ’। তাহলে আমার এক সময়ের প্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের দেরিতে হলেও নিদ্রাভঙ্গ হয়েছে। তারা যে ‘নিরপেক্ষ, দক্ষ ও পেশাদার জনপ্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে’ অত্যন্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী ৯টি দাবি তুলে ধরেছে সেগুলো নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য। এমন একটি স্বতঃস্ফূর্ত ও বলিষ্ঠ বক্তব্যই এই মুহূর্তে জাতি তাদের কাছ থেকে আশা করছিল। আমার চাকরিজীবনে নব্বইয়ের দশকে আমি এই সংগঠনের নির্বাচিত সহসভাপতি ছিলাম। (সভাপতির পদটি ছিল মন্ত্রিপরিষদসচিবের জন্য সংরক্ষিত ও অনির্বাচিত। )

সরকারি চাকরিতে রাজনীতির আত্মধ্বংসী অনুপ্রবেশ ঘটেছিল আমাদেরই কয়েকজন উচ্চাভিলাষী অতি চালাক ‘স্মার্ট’ সহকর্মীর কারণে। আজ জনপ্রশাসনের যে দুরবস্থা, প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যে আজ গৃহকর্মীর (উইথ অ্যাপলজি) পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে, তা সম্ভব হয়েছে ওই কতিপয় বেপথু সুযোগসন্ধানী সহকর্মীর আত্মবিক্রয়ের কারণে।  কামনা করি, বর্তমান প্রেক্ষাপটে জনপ্রশাসনের সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব আত্মত্যাগে অর্জিত ‘স্বাধীনতার’ সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার শপথে উদ্দীপ্ত হয়ে দেশবাসীকে সেবাদান করবেন।

আর সৎপথে থেকে, হে আমার অনুজপ্রতিম সহকর্মী, যেটুকু হক-হালালি রুজি আল্লাহপাক তোমার জন্য বরাদ্দ রেখেছেন তাতেই সন্তুষ্ট থেকে আল্লাহর শুকুর গোজার করো, দুর্নীতিকে ঘৃণা করো অন্তর থেকে। তোমার বা তোমার পিতামাতা, পরিবার-পরিজনের এটা নিশ্চয়ই কাম্য নয় যে তুমি দুর্নীতির কলঙ্ক-কালিমা গায়ে মেখে একজন বেনজীর আহমেদ বা মতিউর রহমান হয়ে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হও। ...একবার কেন ভেবে দ্যাখো না দেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে কয়জন তোমার মতো ভাগ্যবান আছে।

প্রাণভরে দু’আ করি, জীবনের চলার পথে সত্য, ন্যায়, ‘সবর’ ও ‘শুকুর’ হোক তোমার পাথেয়। আমিন।

লেখক : সাবেক সচিব, কবি

mkarim06@yahoo.com

এই রকম আরও টপিক