ন্যায়পরায়ণ শাসকের ব্যাপারে মহানবীর সুসংবাদ

ন্যায়পরায়ণ শাসকের ব্যাপারে মহানবীর সুসংবাদ

 শাহাদাত হোসাইন

পৃথিবীকে সুষ্ঠু-সুচারুরূপে পরিচালিত করতে আল্লাহ তাআলা সব মানুষকে শাসক ও প্রজা দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করেছেন। নবীজি প্রজাদের ওপর স্বীয় শাসকের ন্যায়নিষ্ঠ আদেশ মান্য করা আবশ্যকীয় করে দিয়েছেন। অন্যদিকে শাসকদের হুকুম দিয়েছেন প্রজাদের প্রতি ন্যায়-ইনসাফের আচরণ করতে; তাদের অধিকার আদায়ে মনোযোগী হতে। জনগণকে অধিকার বঞ্চিত করা ও জুলুম-অত্যাচার করা ইসলামে মহাপাপ হিসেবে স্বীকৃত।

শাসকদের দায়িত্ব প্রজা-সাধারণের অধিকারগুলোর প্রতি খেয়াল রাখবে; সেগুলো আদায়ে সচেষ্ট হবে। ওমর (রা.) ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা নিযুক্ত হলে সাঈদ ইবনে আমের (রা.) তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘হে ওমর! আমি আপনাকে মানুষের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করার উপদেশ দিচ্ছি। তবে আল্লাহর ব্যাপারে মানুষকে ভয় করবেন না। আর আপনার কথা আপনার কাজের যেন পরিপন্থী না হয়।

কারণ কর্ম দ্বারা সত্যায়িত কথাই সর্বোত্কৃষ্ট কথা। ’ (আসহাবে রাসুলের জীবনকথা-১ : ১৯২)

শাসক শ্রেণির দায়িত্ব প্রজাসাধারণের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়া। তাদের মৌলিক অধিকার তথা খাদ্য, বাসস্থান, পোশাক, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাদের সম্পত্তির হেফাজত করা। বর্তমান সময়ের শাসকরা প্রজাসাধারণের সম্পত্তিকে নিজের সম্পত্তি মনে করেন। ইচ্ছামতো কর আর ট্যাক্স আরোপ করেন, যা নৈতিকতাবিবর্জিত অন্যায় বিষয়। মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) নবীজি কর্তৃক ইয়েমেনের শাসক ছিলেন। এক ব্যক্তি ৩০টি গরুর একটি পাল নিয়ে তাঁর কাছে এলেন। নবীজি তাঁকে ৩০টি গরুতে (জাকাত হিসাবে) একটি বাছুর নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে জন্য তিনি বলেন, আমি নবীজির কাছে না জেনে এর কিছুই গ্রহণ করব না। কারণ নবীজি (সা.) এ ব্যাপারে আমাকে কিছুই বলেননি। (আসহাবে রাসুলের জীবনকথা-৩ : ১৪৬)

শাসকরা সমাজের রক্ষক। তাঁরাই যখন ভক্ষকে পরিণত হবেন, তখন সমাজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। শান্তি উবে যাবে। অস্থিরতা বিরাজ করবে। তাই শাসক শ্রেণির দায়িত্ব হলো, প্রজাসাধারণের ওপর যেকোনো আদেশ কার্যকরের ক্ষেত্রে সহজতা অবলম্বন করা; কঠোরতার পথ পরিহার করা এবং ঘৃণা-বিদ্বেষ না ছড়ানো। সমাজে ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো নবীজির শিক্ষার পরিপন্থী। যে সমাজের শাসকরা ঘৃণা ছড়ান সে সমাজ বা দেশে স্থিতিশীলতা থাকে না। দ্বন্দ্ব-কলহ নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হিসেবে দেখা দেয়। শাসক-প্রজা বিশ্বাস নষ্ট হয়। ফলে সমাজে শান্তি বিঘ্নিত হয়। নবীজি (সা.) মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.)-কে ইয়েমেনের শাসক হিসেবে প্রেরণকালে বলেছিলেন, ‘মুয়াজ! জনগণের সঙ্গে সহজতা করিও, কঠোরতা করিও না। সুসংবাদের বার্তা প্রচার করিও, ঘৃণা ছড়াইও না। ’ (সিরাতে ইবনে হিশাম-২ : ৫৯০)   

শাসকদের উচিত নিজেদের জবাবদিহির মধ্যে রাখা। নিজেকে জবাবদিহির ঊর্ধ্বে মনে না করা। কিয়ামতের দিন শাসকদের রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি বিষয়ের হিসাব দিতে হবে। নেক কাজ করলে তার প্রতিদান পাবেন আর বদ কাজ করলেও তার শাস্তি ভোগ করবেন। নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তিকে ১০ জন ব্যক্তির শাসক নির্বাচন করা হয়েছে। কিয়ামতের দিন তিনি দুই হাত গলার সঙ্গে বাঁধা অবস্থায় উত্থিত হবেন। অতঃপর তাঁর ন্যায়পরায়ণতা তাঁকে মুক্তি দেবে অথবা তাঁর জুলুম তাঁকে ধ্বংস করবে। ’ (আন-নাসিহাতু লির-রায়ি : ২৮)

শাসকদের উচিত রক্তারক্তির পথ পরিহার করা। হানাহানি, খুনাখুনির পথে না হাঁটা। যতটা সম্ভব এ পথ পরিত্যাগ করা উচিত। আলোচনা-পর্যালোচনার মাধ্যমে বিবাদ-বিষম্বাদ পরিহার করা, সম্ভব হলে দ্রুত আলোচনায় বসা শাসকদের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। বৈধ যেকোনো মূল্য একটি জীবন রক্ষা করা গেলে তা রক্ষা করা ফরজ। কোরআনে এসেছে, ‘নরহত্যা কিংবা পৃথিবীতে ধ্বংসাত্মক কাজ করা ছাড়াই যদি কেউ কাউকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল, আর কেউ কারো প্রাণ রক্ষা করলে সে যেন সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল। ’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৩২)