পুঁজিবাজার-ব্যাংক থেকে ডা. শফিক তুলে নিয়েছেন ৫০০ কোটি টাকারও বেশি

পুঁজিবাজার-ব্যাংক থেকে ডা. শফিক তুলে নিয়েছেন ৫০০ কোটি টাকারও বেশি

অনলাইন ডেস্ক

শেখ হাসিনার অপশাসনের যুগে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে আর্থিক খাতের বড় খেলোয়াড় হতে চেয়েছিলেন দেশের বিশিষ্ট পেইন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. জুনায়েদ শফিক। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদের আত্মীয় (কাজিন) ডা. শফিক পুঁজিবাজার ও ব্যাংক থেকে নিজের প্রতিষ্ঠান নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের নামে তোলেন ৫০০ কোটি টাকারও বেশি অর্থ। তবে এসব অর্থ প্রতিষ্ঠানের কাজে না লাগিয়ে ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ডা. জুনায়েদ শফিকের বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগের ফিরিস্তি তুলে ধরে দেশের একটি গণমাধ্যম।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পেইন মেডিসিন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা ডা. শফিক। এছাড়া জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালেরও অন্যতম কর্ণধার তিনি। তবে গত কয়েক বছরে চিকিৎসক নয়, তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন আর্থিক খাতের পরিচিত মুখ।

নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের পর্ষদে চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন আনিসুজ্জামান চৌধুরী।

তিনি সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ভাই ও চট্টগ্রামের প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরীর ছেলে। তার স্ত্রী ইমরানা জামান চৌধুরী রয়েছেন পরিচালক হিসেবে। নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. জুনায়েদ শফিকের স্ত্রী মাসুমা পারভীনও পরিচালক হিসেবে রয়েছেন।

প্রয়াত শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম ও তার উত্তরসূরিরাই নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের মূল উদ্যোক্তা। তবে ডা. জুনায়েদ শফিক ২০২০ সালের নভেম্বরে ও তার স্ত্রী মাসুমা পারভীন ওই বছরের ডিসেম্বরে পর্ষদে আসার আগেই ইসলাম পরিবারের অধিকাংশ সদস্য কোম্পানি ছেড়ে যান। জহুরুল ইসলামের ছেলে মনজুরুল ইসলাম কেবল নামে ২০২২-২৩ হিসাব বছর পর্যন্ত পরিচালক হিসেবে ছিলেন, যিনি এখন শুধু একজন শেয়ারহোল্ডার। বর্তমানে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসে ডা. জুনায়েদ শফিক, আনিসুজ্জামান চৌধুরী রনি ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্টদেরই আধিপত্য বেশি।

সূত্রে জানা গেছে, নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের ২০২০ সালের জুন শেষে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৫ কোটি টাকা। ডা. জুনায়েদ শফিক পর্ষদে যোগ দেয়ার পর থেকেই কোম্পানিটির ঋণ বাড়তে থাকে। প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) আগে ২০২২ সালের ৩১ মার্চ শেষে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ২৯২ কোটি টাকায়। সর্বশেষ চলতি বছরের মার্চ শেষে কোম্পানিটির ঋণ ৪৭৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

আইপিওতে আসার আগে ২০২০ সালের জুন শেষে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের পরিশোধিত মূলধন ছিল মাত্র ৮ লাখ ১ হাজার ৫০০ টাকা। তবে এক বছর পরই তা বেড়ে ৮০ কোটি ২৩ লাখ ১ হাজার ৫০০ টাকায় দাঁড়ায়। প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে মূলত আইপিওর আগে কোম্পানিটির মূলধন ৮০ কোটি টাকারও বেশি বাড়ানো হয়েছে। উদ্যোক্তা পরিচালকসহ ২৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয় এ মূলধন। এর মধ্যে এনএমআই হোল্ডিংস লিমিটেডের অনুকূলে ৫৬ লাখ ১৬ হাজার ১১০টি, স্ট্র্যাটাস হোল্ডিংস লিমিটেডের অনুকূলে ৮৭ লাখ ১৪ হাজার ৯৫৩টি ও মন্টেনিয়া হোল্ডিংস লিমিটেডের অনুকূলে ৫৫ লাখ ৪৮ হাজার ৩৯টি শেয়ার ইস্যু করা হয়েছে।

এর মধ্যে, এনএমআই হোল্ডিংসের ঠিকানা দেয়া হয়েছে সেন্ট পিটার রোড, গার্নসে এবং স্ট্র্যাটাস হোল্ডিংস ও মন্টেনিয়া হোল্ডিংসের ঠিকানা সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই দেয়া হয়েছে। এনএমআই হোল্ডিংসের ক্ষেত্রে গার্নসের যে ঠিকানা দেয়া সেটি অফশোর লিকসে থাকা বিভিন্ন কোম্পানির নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়েছে। মূলত কর ফাঁকি দেয়ার জন্য এসব দেশে কোম্পানির নিবন্ধন করা হয়।

নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের শেয়ারধারণ কাঠামোয় দীর্ঘদিন ধরেই বিদেশিদের শেয়ারধারণের পরিমাণ দেখানো হচ্ছে ২৭ দশমিক ৭৩ শতাংশ। গত আগস্ট শেষেও এর পরিমাণ অপরিবর্তিত রয়েছে। আইপিওর আগে প্লেসমেন্ট শেয়ার ইস্যু করা এ তিন বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা শেয়ারই মূলত বিদেশী বিনিয়োগ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আইপিওর পর এ তিন কোম্পানির কাছে থাকা শেয়ারের পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ৫২ শতাংশ।

বুক বিল্ডিং পদ্ধতির আইপিওর মাধ্যমে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস পুঁজিবাজার থেকে ২০২২ সালে ৭৫ কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ২১ কোটি ১৮ লাখ টাকার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। এ বছরের মার্চে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের জন্য কোম্পানিটিকে ১৫০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সব মিলিয়ে গত চার বছরে পুঁজিবাজার ও ব্যাংক থেকে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা নিয়েছে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস।

আইপিওর আগে ২০১৯-২০ হিসাব বছরে নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের নিট বিক্রি হয়েছিল ৩১৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা এবং নিট মুনাফা হয়েছিল ১৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকা। ২০২২-২৩ হিসাব বছরে কোম্পানিটির নিট বিক্রি হয় ৫৭০ কোটি ও নিট মুনাফা ৩৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২৩-২৪ হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জুলাই-মার্চ) কোম্পানিটির নিট বিক্রি হয়েছে ৫০৩ কোটি ও নিট মুনাফা ৩৩ কোটি টাকা।

আইকিউভিআইএর তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালে দেশের শীর্ষ ওষুধ বিক্রেতা ২০ কোম্পানির তালিকায় নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের নাম নেই। চিকিৎসকরা কোম্পানিটির চর্মরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ তুলনামূলক বেশি লেখেন। এছাড়া ঢাকা মেডিকেলের বহির্বিভাগে কোম্পানিটির বিক্রয় প্রতিনিধিরা তাদের গ্যাস্ট্রিকের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের বিষয়টিই চিকিৎসকদের কাছে প্রচার করেন। এছাড়া কোম্পানিটি পশু ও পোলট্রির চিকিৎসায় ব্যবহৃত কিছু ওষুধও উৎপাদন করে থাকে। তবে এক্ষেত্রেও শীর্ষ কোম্পানিগুলোর তালিকায় নেই নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালস।

ডা. জুনায়েদ শফিক ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। তিনি বর্তমানে মেঘনা ব্যাংকের পর্ষদে পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিরও ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। তালিকাভুক্ত কোম্পানি জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের প্রতিনিধি হিসেবে ডা. জুনায়েদ শফিক ডেল্টা লাইফের পর্ষদে আসেন। জেনেক্স ইনফোসিসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমাম, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী-রুবাইয়াত-উল-ইসলামসহ পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গেই ছিল তার বেশ সখ্যতা।

মূলত বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যানের সঙ্গে সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ডা. জুনায়েদ শফিক তার কোম্পানিকে আইপিওতে অনুমোদনের পাশাপাশি এ বছর বন্ড ইস্যুর অনুমোদন নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তাছাড়া শিবলী রুবাইয়াতের মাধ্যমে ডেল্টা লাইফের পর্ষদের চেয়ারম্যানকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনাও করেছিলেন তিনি। যদিও তার সে চেষ্টা সফল হয়নি। বরং ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে তিনি ডেল্টা লাইফের পর্ষদ ছেড়ে যান।

বিএসইসি ও আর্থিক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ভাই হিসেবে বিগত সময়ে ডা. জুনায়েদ শফিক বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। বিশেষ করে আইপিও ও বন্ডের অনুমোদন, ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি এ প্রভাব কাজে লাগিয়েছেন। ব্যাংক ঋণের অর্থ কোম্পানির স্বার্থে ব্যবহার হয়েছে, নাকি ডা. জুনায়েদ শফিক ও সহযোগীরা ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করেছেন সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ডা. শফিকের কাছে অনেক নগদ অর্থ থাকার বিষয়টি তিনি প্রায়ই সংশ্লিষ্টদের কাছে বলতেন। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে তার সম্পদ রয়েছে বলেও সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। এক্ষেত্রে আইপিওর আগে যে তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে সেগুলো মূলত সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ও তার পরিবারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বলেই মনে করছেন তারা। যুক্তরাজ্য ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে সাইফুজ্জামান চৌধুরী ও তার পরিবারের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। তাছাড়া পুঁজিবাজারের আলোচিত বিনিয়োগকারী আবুল খায়ের হিরু ও তার সঙ্গী-সাথিদের সঙ্গে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারে ডা. জুনায়েদ শফিকের বিনিয়োগ রয়েছে বলে তারা জানিয়েছেন।

গত ৫ আগস্টের পর দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ডা. জুনায়েদ শফিক প্রভাবশালী একটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে লিয়াজোঁ করার চেষ্টা করছেন বলেও জানা গেছে। এসব বিষয়ে জানতে ডা. জুনায়েদ শফিকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাড়া পাওয়া যায়নি। তাকে এ বিষয়ে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।

নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের ঋণ ও প্লেসমেন্ট শেয়ারের বিষয়ে জানতে চাইলে কোম্পানি সচিব লরেন্স শ্যামল মল্লিক বলেন, ‘আগের তুলনায় আমাদের বিক্রি বেড়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কোম্পানির চলতি মূলধনের প্রয়োজনে কোম্পানির ঋণ বেড়েছে। যে তিনটি বিদেশী কোম্পানির কাছে প্লেসমেন্ট শেয়ার বিক্রি করা হয়েছে সেগুলো সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ কিংবা তার পরিবারের কারো সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। ’

নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের আইপিও প্রক্রিয়ার সময় কোম্পানিটির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) ছিলেন মো. আবু হুরায়রা। গত জুনে দায়িত্ব ছাড়া এ কর্মকর্তার কাছে ঋণের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মূলত ব্যবসার প্রয়োজনে চলতি মূলধন বাবদ কোম্পানির ঋণ বেড়েছে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ঋণ বাড়ার অন্যতম একটি কারণ। ঋণ পরিশোধের জন্য বন্ড ইস্যু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে পর বন্ডে আশানুরূপ সাবস্ক্রিপশন হয়নি। ’

বিদেশি তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে আইপিওর আগে শেয়ার বিক্রির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবেই কোম্পানির আগের উদ্যোক্তারা এ তিন প্রতিষ্ঠানের কাছে শেয়ার বিক্রি করেছেন। এ শেয়ার বিক্রির বিপরীতে কোম্পানি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। ’ তবে এ তিন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ও তার পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শেয়ার কেনার সময় বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকানার যেসব ডকুমেন্ট সরবরাহ করা হয়েছিল, সেখানে তাদের কারো কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। ’