মন্ত্রী-এমপিদের অর্থের পাহাড়, পাচার করেছেন বিদেশে

ছবি: কালের কণ্ঠ

দুদকের অনুসন্ধান

মন্ত্রী-এমপিদের অর্থের পাহাড়, পাচার করেছেন বিদেশে

নিজস্ব প্রতিবেদক

সদ্য পতিত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের অর্ধশত মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ক্ষমতার অপব্যবহার আর ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে গত ১৫ বছরে অর্থের পাহাড় গড়েন মন্ত্রী-এমপিরা। তবে তাদের বেশীরভাগ অর্থই বিদেশে পাচার হয়েছে বলে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধান থেকে জানা গেছে।

দুদুক গত এক মাসে যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনুসন্ধান করে তাদের মধ্যে ৮৩ জনই সাবেক মন্ত্রী-এমপি।

এদের মধ্যে অর্ধশত মন্ত্রী-এমপির বিদেশে সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে দুদক। পাচারকারীরা হলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত-বিষয়ক উপদেষ্টা ও এমপি সালমান এফ রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক অর্থমন্ত্রী ও এমপি আ হ ম মুস্তফা কামাল, সাবেক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ও এমপি ডা. দীপু মনি, সাবেক ভূমি-মন্ত্রী ও এমপি সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, সাবেক নৌ-মন্ত্রী শাজাহান খানসহ আরও অনেকে।

এ ছাড়া এস আলম গ্রুপের মালিক সাইফুল আলম মাসুদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া ও সাবেক ডিবি-প্রধান হারুন অর রশীদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারসহ ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা অন্তত ৭০ জনের বিরুদ্ধে বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দুদকের হাতে রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, ‘দুদকের আমলে নেওয়া অভিযোগে এবং কমিশনের গোয়েন্দা অনুসন্ধানে প্রায় সব মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই বিদেশে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বিএফআইইউতে তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশে সম্পদের তথ্য চেয়ে এমএলএআর করা হয়েছে। বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারে জোর প্রচেষ্টা নিয়েছে দুদক। ’

দুদকের সাবেক মহাপরিচালক মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, ‘দেশ থেকে অর্থ-পাচার বন্ধ করতে হবে। এমনকি বিদেশে পাচার-কৃত অর্থ পুনরুদ্ধারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। পুরো সিস্টেমের উন্নয়ন করতে হবে। এখনই এর উপযুক্ত সময়। অর্থ-পাচার বন্ধের পাশাপাশি পাচারকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। ’

আলোচিত তিন ব্যবসায়ীর অর্থ-পাচার

গত ১৫ আগস্ট এস আলম গ্রুপ ও নাফিজ সরাফতের এবং ২২ আগস্ট সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানে নামে দুদক। দুদকের আমলে নেওয়া অভিযোগে বলা হয়, দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচিত এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং পদ্মা ব্যাংকের পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সরাফাত আর্থিক খাত থেকে নজিরবিহীন দুর্নীতি, লুটপাট, জালিয়াতি ও টাকা পাচার করেছেন। এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে এক লাখ কোটি টাকা পাচার, চৌধুরী নাফিজ সরাফতের বিরুদ্ধে ৮০০ কোটি টাকা পাচার ও ‘দরবেশ খ্যাত’ সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে।

আলোচিত-সমালোচিত কতিপয় সেনা, পুলিশ ও আমলাও তালিকায়

সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, সাবেক ডিবি-প্রধান হারুন অর রশীদ ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব কবির বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধে হাজার হাজার কোটি টাকার জ্ঞাত আয়-বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং তা বিদেশে পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ দুদকের হাতে রয়েছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর জেনারেল আজিজ আহমেদ, গত ১৮ আগস্ট আছাদুজ্জামান মিয়া ও হারুন অর রশীদ এবং গত ২৫ আগস্ট কবির বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।

যেসব মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালী অর্থ-পাচারে জড়িত

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, সাবেক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক ভূমি-মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী, সাবেক নৌপরিবহন-মন্ত্রী শাজাহান খানসহ অন্তত ৭০ সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ রয়েছে।

এ ছাড়া সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সাবেক খাদ্য-মন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, সাবেক ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, সাবেক মন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, খালিদ মাহমুদ, চৌধুরী ফরিদুল হক, ইমরান আহমদ, জাকির হোসেন, কামাল আহমেদ মজুমদার, জাহিদ আহসান রাসেল, নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন, শাজাহান খান, হাছান মাহমুদ, কামরুল ইসলাম, হাসানুল হক ইনু, দিনাজপুর-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার, নেত্রকোনা-৩ আসনের সাবেক এমপি অসীম কুমার উকিল ও তাঁর স্ত্রী যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি অপু উকিল, সিরাজগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক উপপ্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন, সাবেক সহকারী (পিয়ন) ৪০০ কোটি টাকার মালিক মো. জাহাঙ্গীর, সাবেক বন ও পরিবেশ মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন এবং সাবেক এমপি নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন, সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, বরিশাল-২ আসনের সাবেক এমপি শাহ আলম তালুকদার, বরগুনা-১ আসনের সাবেক এমপি ধীরেন্দ্র নাথ শম্ভু ও তাঁর ছেলে সুনাম দেবনাথ, গাইবান্ধা-৪ আসনের এমপি মো. আবুল কালাম আজাদ, রাজশাহী-৫ আসনের এমপি ডা. মনসুর রহমান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান, চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সাবেক এমপি সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার, দিনাজপুর-৩ আসনের সাবেক এমপি ইকবালুর রহিম, মাগুরা-১ আসনের এমপি সাইফুজ্জামান শেখর, সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম, সিরাজগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি তানভীর ইমাম, সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্ত এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, সাবেক শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান, নাটোর-২ আসনের সাবেক এমপি মো. রফিকুল ইসলাম শিমুল, মানিকগঞ্জ-১ আসনের সাবেক এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয়, রাজশাহী-৪ আসনের সাবেক এমপি মো. এনামুল হক, সাবেক এমপি মো. নিজাম হাজারী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ, হবিগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক এমপি মাহবুব আলী, খুলনা-৬ আসনের সাবেক এমপি মো. আখতারুজ্জামান বাবুর নামও রয়েছে এই তালিকায়।

পাচার-কৃত অর্থের গন্তব্য

আগে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের জনপ্রিয় গন্তব্য ছিল সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, কানাডাসহ করস্বর্গ খ্যাত কিছু দ্বীপরাষ্ট্র। তবে গত কয়েক বছরে অর্থ পাচারের গন্তব্যে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বা পূর্ব ইউরোপের মতো দেশগুলোকে অর্থের নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে বেছে নিচ্ছেন বাংলাদেশি পাচারকারীরা।

যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের (সিঅ্যান্ডএডিএস) সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইই-উ ট্যাক্স অবজারভেটরি জানিয়েছে, বাংলাদেশে তথ্য গোপন করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে প্রপার্টি কেনেন ৪৫৯ বাংলাদেশি। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাঁদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রপার্টি ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে, কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ডলার। মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের তালিকায়ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছেন বাংলাদেশিরা। এখন পর্যন্ত তিন হাজার ৬০৪ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ গড়েছেন বলে গত মার্চে জানিয়েছেন দেশটির শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রী টিয়ং কিং সিং। এ ছাড়া কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সিঙ্গাপুরেও বাড়ি-ফ্ল্যাটসহ বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগের তথ্য রয়েছে।

news24bd.tv/JP