হাছান মাহমুদের দখলদারিত্বের ফিরিস্তি

হাছান মাহমুদ

হাছান মাহমুদের দখলদারিত্বের ফিরিস্তি

অনলাইন ডেস্ক

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তার সরকারের মন্ত্রী-এমপিদের অবৈধভাবে গড়া সম্পদের খোঁজ মিলছে।  সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ গত সাড়ে ১৫ বছরে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেশ-বিদেশে অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। জানা যায়, তার বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ জায়গাজমি বেদখলের অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে বন বিভাগেরই রয়েছে প্রায় ২১২ একর জমি।

চট্টগ্রামের অনন্যা আবাসিক এলাকা, দেওয়ানবাজার মৌসুমি মোড়, খুলশীসহ আরও কয়েকটি স্থানে তার কোটি কোটি টাকার অবৈধ প্লট, ফ্ল্যাট ও বাড়ি রয়েছে বলে জানা যায়।

অভিযোগ রয়েছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন চার মেয়াদের সরকারে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকাকালে দেশের বাইরেও বিপুল সম্পদ গড়ে তোলেন আওয়ামী লীগের এই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। তার অবৈধ সম্পদ ও দুর্নীতির বিষয়ে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিআইএফইউ) ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান করছে বলে জানা গেছে।

সরকার পতনের পর হত্যা, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের অভিযোগে হাছান মাহমুদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় এক ডজনের বেশি মামলা করা হয়েছে।

গত ১১ আগস্ট বিএফআইইউ হাছান মাহমুদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে বলে জানা যায়।

বর্তমানে চট্টগ্রাম-৭ আসনে (রাঙ্গুনিয়া ও বোয়ালখালী আংশিক) টানা চারবারের সাবেক এই সংসদ সদস্যের খোঁজ নেই।  গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরের দিন হাছান মাহমুদ বিদেশে পালানোর সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে আটক হয়েছেন বলে শোনা যায়। তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে বেলজিয়াম গেছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। তবে তার বিদেশভ্রমণে সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি যে তিনি এখন কোথায়।

হাছান মাহমুদ না থাকায় রাঙ্গুনিয়ার অনেকে এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত প্রবীণ এক নেতা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘হাছান মাহমুদের কারণে গত সাড়ে ১৫ বছর রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকতে বাধ্য হয়েছি। আওয়ামী লীগের আরো অনেক ত্যাগী, বঞ্চিত নেতাকর্মী এলাকায় থাকতে পারেননি। এখন তাঁদের অনেকে এলাকায় আসছেন। ’

ভুক্তভোগীরা জানান, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে পছন্দের প্রার্থীদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়ার ব্যবস্থা করতেন তিনি। হাছান মাহমুদ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে থাকাকালে নিজ পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি গাড়িচালক, একান্ত সহকারী, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুসহ অনেকে এখন কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন।

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব আবু আহমেদ হাসনাত গণমাধ্যমকে বলেন, ‘হাছান মাহমুদ ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রথমবার এমপি হওয়ার পর থেকে আমাদের দলসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের এলাকাছাড়া হতে হয়েছিল। আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চার-পাঁচ শ গায়েবি মামলা দেন তিনি। আমার বিরুদ্ধে শহরের বিভিন্ন থানায় ১১টি মামলা দিয়েছেন। ’

নাম প্রকাশ না করে আওয়ামী লীগ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের কয়েকজন নেতা জানান, আওয়ামী লীগের বাইরে ‘ড. হাছান মাহমুদ লীগ’ ছাড়া রাঙ্গুনিয়ায় কোনো রাজনীতি ছিল না। কেউ দল থেকে প্রার্থী হবেন শুনলেই তাকে নানাভাবে হয়রানি করা হতো। তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা যেত না। ’

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য (এমপি) হন হাছান মাহমুদ। অভিযোগ রয়েছে, ওই সরকারে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনকালে এলাকায় তাঁর প্রভাব খাটিয়ে ছোট ভাই এরশাদ মাহমুদ শত শত একর সরকারি বনভূমি অবৈধভাবে দখল করে নেন। এসব জমিতে তিনি পর্যটনকেন্দ্রসহ বিভিন্ন প্রকল্প গড়ে তোলেন।

হাছান মাহমুদের বিরুদ্ধে জাহাজ নির্মাণের ডকইয়ার্ড দখলেরও অভিযোগ রয়েছে। স্ত্রীর নামে নিয়েছেন শিপ হ্যান্ডলিং লাইসেন্স। হয়েছেন ফিশিং ট্রলারের মালিক। এর মধ্যে এক ডকইয়ার্ড মালিক তাঁর কাছে ৬০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন। জলবায়ু তহবিল থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতেরও অভিযোগ রয়েছে হাছান মাহমুদের বিরুদ্ধে।

গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ টানা চারবার ক্ষমতায় আসে। এ সময় হাছান মাহমুদও চারবার চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি নির্বাচিত হন। তিনি গত সাড়ে ১৫ বছরে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী, বন ও পরিবেশ মন্ত্রী, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী এবং সর্বশেষ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। আওয়ামী লীগের সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলনে তাঁকে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এর আগে তিনি দলটির প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন।

নির্বাচনী এলাকা রাঙ্গুনিয়ার খুরুশিয়া রেঞ্জে ড. হাছান মাহমুদের ছোট ভাই এরশাদ মাহমুদ বন বিভাগের প্রায় ২১২ একর জমি দখল করেন। ২০০৯ সাল থেকে দখল করা এসব বনভূমিতে তিনি গড়ে তোলেন গয়াল খামারের পাশাপাশি গরু ও মহিষের খামার, পুকুর, বাগান, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন স্থাপনা।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আশরাফুল ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা এর মধ্যে কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে ২০০ একর বনভূমি উদ্ধার করেছি। আমরা এখন খুব স্বস্তিতে। কোনো ধরনের রাজনৈতিক চাপ নেই। স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছি। ’ তবে এরশাদ মাহমুদ বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে দাবি করেছেন, সরকার থেকে লিজ নিয়েই বনের জমিতে তাঁরা খামার গড়ে তুলেছিলেন। বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, বনভূমি লিজ নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

২০২১ সালের মার্চে চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তীরে এফএমসি নামের একটি ডকইয়ার্ড দখলের অভিযোগ ওঠে হাছান মাহমুদের বিরুদ্ধে। তাঁর পক্ষে ভাই খালেদ মাহমুদ নিরাপত্তাকর্মীদের মারধর করে এই ডকইয়ার্ড দখল করে নেন। এই মারধরের একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। হাছান মাহমুদের স্ত্রী নুরান ফাতেমার নামে গড়া একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এফএমসির চুক্তি, ফিশিং ট্রলার নির্মাণের চুক্তিসহ বিভিন্ন দলিল সৃষ্টি করা হয়। ব্যাংকঋণের বিশাল বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় এফএমসির নামে।

হাছান মাহমুদ মন্ত্রী থাকার কারণে তার অনেক অন্যায় আবদার মেনে নিতে হয়েছে বলে দাবি করে এফএমসি ডকইয়ার্ডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইয়াসিন চৌধুরীর পরিবার। সরকার পতনের পর সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ্যে তাঁর ডকইয়ার্ড দখলের বিষয়টি সামনে আনা হয়। একই সঙ্গে ৬০০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে হাছান মাহমুদ এবং তাঁর স্ত্রীর নামে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন বলেও তাঁরা জানান।

এ ছাড়া হাছান মাহমুদ নিজে প্রভাব খাটিয়ে তাঁর ছোট ভাই খালিদ মাহমুদকে চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালক পদে বসান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেস ও পাবলিকেশন অ্যান্ড অ্যাডভারটাইজমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রভাব খাটিয়ে একাধিক স্বজনকে চাকরি দেন হাছান মাহমুদ।

হাছান মাহমুদের সুপারিশ ও চাপে নিজ নির্বাচনী এলাকা রাঙ্গুনিয়ায় জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ ‘সাইট অ্যান্ড সার্ভিসেস আবাসিক প্লট উন্নয়ন’ শীর্ষক ৪১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয়। ২০১৪ সালে এই প্রকল্পের জন্য হাছান মাহমুদ ডিও লেটার দেন। এটি বাস্তবায়নে আপত্তি ছিল সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের। রাঙ্গুনিয়ার ইছাখালীতে প্রকল্প এলাকার ৭০ শতাংশ পাহাড় এবং ৩০ শতাংশ জলাধার থাকায় বিভিন্ন সংস্থার আপত্তিতে প্রকল্পটি বাতিল করা হলেও ২০২০ সালের মার্চে তা অনুমোদিত হয়।

অভিযোগ উঠেছে, তিনি চাপ সৃষ্টি করে এই প্রকল্প অনুমোদন করান। সম্প্রতি এই আবাসন প্রকল্পের পরিবেশগত ছাড়পত্র বাতিল করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৭ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে গত বছরের ২৯ নভেম্বর নিজের হলফনামা জমা দেন হাছান মাহমুদ। এতে তাঁর দুই কোটি ২৮ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হিসেবে প্রাপ্ত ভাতা বাদে কৃষি খাতসহ বিভিন্ন খাত থেকে তাঁর বার্ষিক আয় দেখানো হয় দুই লাখ ৭৭ হাজার টাকা। ২০ লক্ষাধিক টাকার অস্থাবর সম্পদ এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মাত্র ১২ লাখ টাকা জমা দেখানো হয়। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠজন এবং আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার ভাষ্য, হাছান মাহমুদ নির্বাচনী হলফনামায় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের যে তথ্য দিয়েছেন বাস্তবে এর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ-সম্পদের মালিক।

হলফনামায় হাছান মাহমুদের স্ত্রী নুরান ফাতেমার ১০ কোটি ৩৫ লাখ টাকার স্থায়ী ও অস্থায়ী সম্পদ দেখানো হয়েছে। তিনি চট্টগ্রাম নগরীর সিরাজউদ্দৌলা সড়কে চৌধুরী টাওয়ার নামের একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। এই ভবনেই তাঁর শতকোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে বলে দাবি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। যদিও এই ভবন তাঁর শ্বশুরপক্ষের বলে পরিবার থেকে দাবি করা হয়।

সরকার পতনের দিন সিরাজউদ্দৌলা রোড ও মৌসুমি মোড়ের ভবন দুটিতে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর করে বিক্ষুুব্ধ জনতা।

নির্বাচনের হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী হিসেবে প্রাপ্ত ভাতা ছাড়া হাছান মাহমুদের বার্ষিক আয় দুই লাখ ৭৭ হাজার টাকা। কিন্তু দুদকে দেওয়া অভিযোগের তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে ১৫ বছরে হাছান মাহমুদের সম্পদ বেড়েছে চার হাজার ৬৮৩ গুণ। তিনি নামে-বেনামে হাজার কোটি টাকার মালিক। শুধু দেশেই নয়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের আজমান নামের এলাকায় বিপুল পরিমাণ জায়গা কিনে বাড়ি, হোটেলসহ বিভিন্ন স্থাবর সম্পদ করেছেন তিনি।

খুলশী, বাকলিয়া মৌজায় রয়েছে তার কয়েক একর সম্পত্তি। নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যাংকে রয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও এফডিআর। এ ছাড়া বাড়ি কিনেছেন কানাডায়ও। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাঁর অঢেল সম্পদ রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।  

news24bd.tv/আইএএম

এই রকম আরও টপিক