একটা গল্প বলি আগে: বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষে আমরা একটা পাঠচক্র করেছিলাম। উদ্দেশ্য: মার্কসিজম পাঠ। উদ্যোগটা নিয়েছিলেন এক বন্ধু, তখন তিনি তুখোড় বিপ্লবী এবং কড়া মার্কসিস্ট। তিনি ভাবলেন, আমাদের মত কিছু ফ্লোটিং এলিমেন্টকে সমাজতন্ত্রের ঝাণ্ডার নিচে আনা দরকার।
মার্কস পঠনে আমাদের আগ্রহ ছিল, সমাজতন্ত্র কায়েমে খুব আপত্তি ছিল না, কিন্তু ঝাণ্ডার নিচে আসার ব্যাপারে সম্ভবত ছিল।
কিছুদিন যেতেই বুঝলাম, এটা অত্যন্ত ম্যানিপুলেটেড একটা সিলেবাস। এখানে মার্কসের কিছু বই আছে, কিন্তু এংগেলস বেশি। প্লেখানভ আছে, অথচ মাও নাই। আমাদের এক বন্ধু নিও মার্কসিজম পড়তে চাইল। কিন্তু অধিকর্তা সেটা মানলেন না। নৃতত্ত্বের বন্ধুরা লেভী স্ট্রাউস দিয়ে এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সিলেবাসের বিরূদ্ধে লড়াই চালাতে লাগলেন। হাউ কাউ লেগে গেল। একজন বললেন, এটা কি পাঠচক্র, নাকি পাঠচক্রান্ত? সুকৌশলে একটা নির্দিষ্ট পার্টির দিকে আমাদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে! বন্ধু এক পর্যায়ে ক্ষান্ত দিলেন। যাওয়ার আগে অভিশাপ দিলেন, আমাদের পরিণাম "মুত্সু্দ্দী বুর্জোয়া"দের মত হবে!
মুত্সুদ্দী বুর্জোয়া জিনিসটা ভালমত জানি না। কিন্তু সেটা না হবার ভয়ে থাকতাম এর পর থেকে। ইন ফ্যাক্ট, কোনো কিছুই না হবার এক নেগেটিভ ডায়ালেকটিকস মনের মধ্যে গেঁড়ে বসল। সেই ভ্যানগার্ড বন্ধু পরে আওয়ামী লীগের ঝাণ্ডার নিচে যোগ দিলেন।
ঐতিহাসিক সত্যটা হল, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন যারা শুরু করেছিলেন তারা একটা পাঠচক্রের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। একটা চিন্তাপ্রক্রিয়ার মধ্যে ছিলেন। মাহফুজ আলম তাদেরই একজন। এটা আপনাকে মানতে হবে। আন্দোলন সফল করতে গিয়ে আরো অনেক শিক্ষার্থী জনতা এর সাথে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু শুরুটা ওরাই করেছিলেন।
তাদের শুরুর দিকের একটা বড় কৌশল ছিল ইনক্লুসিভিটি। ফ্যা/সি.স্ট সরকারের যারাই সমালোচক, সাফারার -- সবাইকে এই মন্ত্রে একসাথে করতে পেরেছিলেন তারা। এটা পরবর্তীতে তাদের জন্য একটা ক্রাইসিস তৈরি করেছে মে বি। এই ইনক্লুসিভ পজিশনালিটির সুযোগ নিয়ে ভারতীয় কিছু মিডিয়া এবং গুজববাজরা তাদের কাউকে কাউকে হিজবুত তাহরীর, শিবির বলে ট্যাগাচ্ছে। এটা হয়ত অস্বস্তিকর লাগছে তাদের। যে কারণে মাহফুজ বেশ কিছু পজিশন ডিজঅউন করেছেন তার স্ট্যাটাসে। আমার মনে হয়, এটার দরকার ছিল না।
মাহফুজ আলম একটা বাড়তি মনস্তাত্ত্বিক চাপ নিয়েছেন এর মাধ্যমে। নিজেকে ডিফাইন করার চাপ। যেটি করতে গিয়ে তিনি রাষ্ট্র ও সমাজের "সভ্যতাবাদী রূপান্তরের" প্রসঙ্গ এনেছেন। আমাদের পাঠচক্রে আমরা যখন এঙ্গেলসকে রিজেক্ট করতে গিয়ে নিওমার্কসিস্টদের হাজির করতাম, সেটা আমরা রিজেক্ট করার আনন্দেই করতাম। আমাদের কাঁধে তো আর রাষ্ট্রের দায়ভার ছিল না। আর আমরা কোনো সফল অভ্যুত্থানও করি নাই। ফলে দায় কম ছিল। ফলে নেগেটিভ ডায়ালেকটিকস আর ভবঘুরে চিন্তার জীবন চালিয়ে যেতে পেরেছি। আননোটিশড থেকে।
মাহফুজদের সেই লাক্সারি নাই। তাকে আমরা সবাই চোখে চোখে রাখছি। তার প্রতিটা কথাই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটা ব্যাখ্যাই ডিউ। নেতিকরনের কাজটা মে বি তিনি খুব বৈষয়িক প্রয়োজনে করেছেন। কিন্তু আমার মনে হয় না ট্যাগানো তাতে বন্ধ হবে। যারা ট্যাগাচ্ছে তাদের এজেন্ডা ভিন্ন। কিন্তু এই নেতিকরণ তার এবং তাদের বৃহত্তর পজিশনকে কিভাবে ডিফাইন/রিডিফাইন করে সেটা জানা জরুরি। আমরা এই তরুণদের প্রাণ দিয়ে ভালবাসি, এবং আমাদের অসফল চিন্তা এরং চর্চাগুলোর উত্তরাধিকার বলেও ভাবি। তাদের অপার ভালবাসার মধ্যে আমাদের জন্য সেটুকু জায়গা তারা রাখবেন হয়ত। তাদের চোখ দিয়েই আমরা আমাদের ভবিষ্যতকে জানতে ও বুঝতে চাই। এবং সেইসাথে একটা প্রতিযোগিতামূলক চিন্তাসম্পর্কও বজায় রাখতে চাই।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক , ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়
news24bd.tv/ডিডি