উন্নয়ন অংশীদারি দুই দেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ ও দৃঢ় করবে

উন্নয়ন অংশীদারি দুই দেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ ও দৃঢ় করবে

এ কে এম আতিকুর রহমান

গত ২১ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে যান। ২২ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তাঁর দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ও ভারতে নতুন সরকার গঠনের পর এটিই ছিল দুই দেশের সরকারপ্রধানদের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রথম দ্বিপক্ষীয় বৈঠক, যদিও শেখ হাসিনা এ মাসেই অনুষ্ঠিত নরেন্দ্র মোদির তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ভারত সফরে গিয়েছিলেন। দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে উভয় দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয় নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শেষে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের সহযোগিতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে তিনটির নবায়নসহ ১০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।

আনুষ্ঠানিক বৈঠকের আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় তিস্তা ইস্যু। কারণ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও চায় তিস্তা সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে ভারত আন্তরিক হবে। তাই বাংলাদেশ এই বিষয়টি উত্থাপন করলে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিস্তার পানিপ্রবাহ বৃদ্ধিসহ নদীটির সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাস দেয় এবং প্রক্রিয়াটি শুরু করার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটি কারিগরি দল বাংলাদেশে প্রেরণের কথা জানায়। ভারতের এই মনোভাব বাংলাদেশ অত্যন্ত ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে এবং আশা করছে যে এর ফলে দুই দেশই সমানভাবে উপকৃত হবে।

এ ছাড়া আলোচনায় স্থান পেয়েছে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, সংযোগ, জ্বালানি, বাণিজ্য, সমুদ্রসম্পদ, বাংলাদেশের ব্রিকসে যোগদানে ভারতের সমর্থন, রোহিঙ্গা সমস্যা, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি ইস্যু। আমরা জানি, সীমান্ত হত্যা বন্ধে এরই মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক আলাপ-আলোচনাই হয়েছে। তার পরও সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামানো যায়নি। বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, যা দুই দেশের জনগণের মধ্যকার সম্পর্ককে অনেকটা তিক্ত করতে পারে।

তাই সীমান্তে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে সুযোগ থাকলে হত্যা না করে বিকল্প পদ্ধতি অনুসরণে সৃষ্ট সমস্যা থেকে উত্তরণের বিষয়টি দুই দেশকেই ভাবতে হবে। সীমান্তে নিয়োজিত উভয় দেশের বাহিনীকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে, যাতে কোনো দেশেরই নিরাপত্তায় বিন্দুমাত্র আপস না করেও শান্তিপূর্ণ সমাধান করা যায়। বাংলাদেশের জন্য ব্রিকসে যোগদানের চেয়ে বোধ হয় রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন অধিক জরুরি। এ উন্নয়ন অংশীদারি দুই দেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ ও দৃঢ় করবেক্ষেত্রে ইচ্ছা করলেই ভারত কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু ভারত শুধু ‘কথায় নয়, কাজে প্রমাণ করা’র মনোভাব নিয়ে সহযোগিতা করলে রোহিঙ্গা সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান অনেকটাই সহজ হবে।

ভারত পেঁয়াজ, তেল, গম ও চিনির মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের জন্য কোটা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ একটি নির্দিষ্ট কোটা চেয়েছে, যাতে বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে তা সহায়ক হয়। এ ক্ষেত্রে ভারত তার অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পর ওই সব পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দিলে দুই দেশই লাভবান হতে পারে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা আলোচনায় সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমন ছাড়াও প্রতিরক্ষা সরঞ্জামাদি উৎপাদন প্রসঙ্গও উত্থাপিত হয়েছে। দুই দেশের উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখতে হলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নির্মূল করতে হবে। সন্দেহ নেই, এ ক্ষেত্রে যৌথ প্রয়াস অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে তিস্তার সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয় ছাড়াও ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বাংলাদেশিদের জন্য ই-মেডিক্যাল ভিসা প্রবর্তন, রংপুরে ভারতের সহকারী হাইকমিশন স্থাপন, রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে নতুন যাত্রীবাহী ট্রেন চালু, চট্টগ্রাম ও কলকাতার মধ্যে নতুন বাস সার্ভিস, গেদে-দর্শনা ও হলদিবাড়ি-চিলাহাটির দলগাঁও পর্যন্ত মালগাড়ি চলাচল, সিরাজগঞ্জে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো তৈরি, পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণশিবির ইত্যাদির ঘোষণা দেওয়া হয়। আমাদের বিশ্বাস, এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে অবশ্যই দুই দেশের মানুষের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ আরো সহজ ও নিবিড় হবে। তবে একটি কথা না বললেই নয়, বিদেশি কোনো সাহায্য বা সুবিধা গ্রহণের আগে বাংলাদেশকে তার প্রাধিকার এবং পরবর্তী দায়ভার নির্ধারণ করেই সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। মুখ্য বিষয় বাদ দিয়ে যেন গৌণ বিষয় নিয়ে আমরা উত্ফুল্ল না হই। আমাদের স্বার্থ ও সামর্থ্যের কথাও মনে রাখা আবশ্যক।            

সফরকালে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে যে সাতটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেগুলো হলো—বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর অঞ্চলে সমুদ্র অর্থনীতি ও সমুদ্র সহযোগিতা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক; ভারত মহাসাগরে সমুদ্রবিজ্ঞান ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য যৌথ গবেষণার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ওশেনোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট (বিওআরআই) এবং ভারতের কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের (সিএসআইআর) মধ্যে সমঝোতা স্মারক; ডিজিটাল পার্টনারশিপ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক; ভারত-বাংলাদেশ সবুজ অংশীদারি সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক; দুই দেশের মধ্যে রেলসংযোগ সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক; যৌথ ক্ষুদ্র উপগ্রহ প্রকল্পে সহযোগিতার লক্ষ্যে ভারতের জাতীয় মহাকাশ প্রচার ও অনুমোদন কেন্দ্র (ইন-স্পেস) ও মহাকাশ বিভাগ, ভারত সরকার এবং বাংলাদেশের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সমঝোতা স্মারক; ডিফেন্স সার্ভিসেস স্টাফ কলেজ (ডিএসসিসি), ওয়েলিংটন ও ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ (ডিএসসিএসসি) মিরপুরের মধ্যে কৌশলগত ও অপারেশনাল স্টাডিজের ক্ষেত্রে সামরিক শিক্ষা সংক্রান্ত সহযোগিতার জন্য সমঝোতা স্মারক। তিনটি নবায়নকৃত সমঝোতা স্মারক হলো মৎস্য সহযোগিতা স্মারক, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা স্মারক এবং স্বাস্থ্য ও ওষুধের সহযোগিতার ক্ষেত্রবিষয়ক সমঝোতা স্মারক।

শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনেকবারই ভারত সফরে গেছেন। ওই সব সফরে দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, দুই দেশের মধ্যে অনেক দলিলপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে, অনেক সমস্যার নিরসন হয়েছে। কিছু বিষয়; যেমন—তিস্তা সমস্যা এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। তবে তিস্তার কথা কোনো পক্ষই কিন্তু এড়িয়ে যায়নি, সহযোগিতার কিছুটা ইঙ্গিতও পাওয়া গেছে। তাই এবারের সফর সংক্ষিপ্ত হওয়া সত্ত্বেও নতুন ক্ষেত্র ও প্রতিশ্রুতির সৃষ্টি হয়েছে। একে অপরের সমস্যাকে বুঝে নেওয়ার মানসিকতা লক্ষ করা গেছে। পারস্পরিক বোঝাপড়ায় স্বচ্ছতা থাকায় উভয়ের স্বার্থ সংরক্ষণ করে উন্নয়ন অংশীদারির অঙ্গীকার ধ্বনিত হয়েছে।  

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরটি ছিল ভারতের নতুন সরকার গঠনের পর প্রথম কোনো বিদেশি নেতা বা সরকারপ্রধানের প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর। ভারত বাংলাদেশকে কতটা গুরুত্ব দিয়ে থাকে এই সফর সেটিই প্রমাণ করেছে। তা ছাড়া দুই প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ থেকে এটি স্পষ্ট যে দুজনই দুই দেশের সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করতে আগ্রহী দুটি দেশের উন্নত, সমৃদ্ধিশালী ও শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের জন্য। আমাদের বিশ্বাস, দুটি প্রতিবেশীর উন্নয়ন যদি সমন্বিত প্রচেষ্টায় একই গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার এ অঞ্চলের মানুষ শান্তিতে একটি উন্নত জীবন নিয়ে বসবাস করতে পারবে।

তবে আলাপ-আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না, কাজে নেমে পড়তে হবে পরিকল্পিতভাবে এবং আন্তরিকতার সঙ্গে। দুই দেশের জনগণকে একে অপরের সমস্যা বুঝতে হবে, উভয়কেই সংবেদনশীল হতে হবে এবং অসুবিধাগুলোর প্রতিকারের পথ খুঁজে বের করতে হবে। পারস্পরিক আস্থাকে ভিত্তি করে উভয়কেই ভালো থাকার সমন্বিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশের ‘ভিশন-২০৪১’ ও ভারতের ‘বিকশিত ভারত-২০৪৭’ একই গতিতে এগিয়ে যাবে পরিপূর্ণ প্রস্ফুটনের জন্য, তেমনই আশাবাদের ইঙ্গিত রয়েছে দুই দেশের শীর্ষ নেতাদের আলাপে, আশ্বাসে, আস্থায়, সহমর্মিতায় এবং দেশ গড়ার অদম্য সাহসিকতাপূর্ণ ইচ্ছাশক্তিতে। ফলে দুই দেশের সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারে উন্নয়ন অংশীদারির অব্যাহত কর্মকাণ্ডের বাস্তবায়নে। কেউ কাউকে উপেক্ষা নয়, বরং সহমর্মিতার আচ্ছাদনে সব সমস্যা পরাভূত করার মানসিকতা থাকতে হবে। উন্নয়ন অংশীদারির প্রয়াসে শুধু নিজের স্বার্থই নয়, অপরের স্বার্থও সংরক্ষণ করতে হবে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য। তাহলেই শেখ হাসিনার এ সফরের সাফল্য আসবে।  

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব

সম্পর্কিত খবর