পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার (২): তিয়াত্তরের আইনের পটভূমি ও পরিণাম

অলংকরণ, সাদিয়া মুমু

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার (২): তিয়াত্তরের আইনের পটভূমি ও পরিণাম

অনলাইন ডেস্ক

ছাত্র গণঅভ্যুত্থানে সবচাইতে বেশি সামনে এসেছে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্ন। রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রে এর প্রধান প্রধান যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে তা সংস্কার দরকার। আর এ কাতারে প্রথম দিকেই পড়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সংস্কারের প্রশ্ন।

এখন থেকে ১৭ বছর আগে ২০০৭ সালে ১/১১ হিসেবে কথিত কুখ্যাত জরুরি আইন লঙ্ঘন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে "মানুষ নেটওয়ার্ক"-এর পক্ষ থেকে "পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার প্রসঙ্গ শিক্ষক ও ছাত্র-রাজনীতি" নামে সেলিম রেজা নিউটন তিন ঘণ্টার একটি বক্তৃতা উপস্থাপন করেছিলেন।

পরে সেটি "যোগাযোগ" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।

বর্তমানে ২০২৪-এর চলমান ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে মূলত সেই আলোচনাটিই ভিডিও আকারে নতুন করে রেকর্ড করে পোস্ট করা হচ্ছে। সে আলোচনার ২য় কিস্তি (১ম অংশ) তুলে ধরা হলো-


১৯৭৩ সালের প্রেক্ষাপট ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট। রক্তক্ষয়ী, ৯ মাস ব্যাপী অসাধারণ একটা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল।

এবং দেশের সবাই প্রায়োজন অনুভব করেছিল যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের আশা- আকাঙ্ক্ষা পূরণের মতো উপযোগী হয়ে উঠতে পারে এবং সে ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় যেন দাড় করাতে পারি।  

৭৩ এর আইন রচনার পেছনে ঐতিহাসিক যে ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল, সেটা হচ্ছে পাকিস্তান আমলের ব্যাকগ্রাউন্ড। ১৯৬২ সালে একটা আইন মোটের উপর ছিল, যে আইনটা দিয়ে আমাদের দেশের পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হতো। সেই আইনটা পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মানুষদের কাছে একটা কালা কানুন হিসেবে পরিচিত ছিল। সেই আইনটা গোটা পাকিস্তান আমল জুড়ে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে অত্যন্ত অপ্রিয় ছিল। এবং সত্যি সত্যি সেই আইনটা একেবারে অগণতান্ত্রিক ছিল, সেই আইনের অধীনে প্রত্যেকটা বিভাগের প্রধান নামে একজন শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া হতো। তাকে বলা হতো বিভাগীয় প্রধান। তার হাতেই সমস্ত বিভাগের একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকতো, তিনি যা খুশি তাই করতেন। তার কাজ ভালো হলে ভালো হতো, তার কাজ খারাপ হলে খারাপ হতো। তাছাড়া ছিল ভাইস চ্যাঞ্চেলরের একচ্ছত্র ক্ষমতা কোনোরকমে বলতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরকার বিধি-বিধান, উপবিধি, প্রবিধান বা নিজস্ব আইন-কানুনের বালাই না রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তার খামখেয়াল-খুশি কিংবা বিজ্ঞ বিবেচনা অনুসারে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতেন।

এক কথায় বললে বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা কাজ করতেন, সেসমস্ত শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা ছিল এরকম তাদের নিজেদের কোনো মতামত দেওয়ার সুযোগ ছিল , তাদের নিজেদের কোনো অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। এবং ৬২ এর এই কালা কানুনের অগণতান্ত্রিক রূপ রেখার অবকাশে পাকিস্তান আমলের শাসকগোষ্ঠী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পুরোদস্তুর তাদের রাজনৈতিক আকাঙ্খা অনুসারে নিয়ন্ত্রণ করতো।  

পাকিস্তান আমলের ৬২ এর এই কালা কানুনের কারণেই এই অভিজ্ঞতায় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে একটা স্বপ্ন তৈরি করে যে স্বাধীন বাংলাদেশে এমন ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় আমরা নিশ্চয়ই পাবো যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা স্বাধীনভাবে তাদের বিবেক অনুসারে, তাদের লেখাপড়া অনুসারে এবং প্রয়োজন অনুসারে তাদের মতামত দিতে পারবেন। এবং তারা স্বাধীনভাবে শিক্ষার কাজগুলো এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ গুলো গণতান্ত্রিকভাবেও পরিচালনা করতে পারবেন।  

সেখানে একজন মাত্র ভাইস চ্যান্সেলরের সমস্ত একনায়কতন্ত্র, এবং সমস্ত রকমের খবরদারি তাদেরকে বাধা তৈরি করবে না। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোর ভিতরে যে বিভাগীয় প্রধান ‘হেড অফ দ্যা ডিপার্টমেন্ট নামে একটা অদ্ভুত, একনায়কতান্ত্রিক নামই ছিল পদটার, সেই বিভাগীয় প্রধানদের একেবারে হুকুম শুনে শিক্ষকদের ওঠা-বসা করতে হতো। বিভাগীয় প্রধান শিক্ষকদেরকে নিয়োগ দিয়ে ফেলতেন । বিভাগীয় প্রধান রুষ্ট হলে প্রমোশন থাকত না। বিভাগীয় প্রধান রুষ্ট হলে চাকরিও চলে যেতে পারতো। সেই পরিস্থিতির বাইরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা স্বাধীনভাবে তাদের কার্যকলাপ পরিচালনা করতে পারবেন এবং দেশের কাজে, দেশের উন্নয়নের কাজে, স্বাধীনতার কাজে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজে দেশের পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তারা তাদের উপযুক্ত কাজ করতে পারবেন, এই স্বপ্ন ছিল ৭৩ এর আইন রচনার পটভূমি।  

কাজেই ৭৩ এর আইনে আমরা মূলত যে জিনিসগুলোর প্রতিফলন দেখলাম সেগুলো হচ্ছে, খুব সংক্ষেপে বললে ৩/৪ টা পয়েন্ট এরকম যে- শিক্ষকেরা স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় যেকোনো প্রকারের শিক্ষা  বিষয়ক মতামত দিতে পারবেন।

প্রথম কিস্তি: https://www.news24bd.tv/details/183579

আরেকটা প্রধান দিক ছিল যে শিক্ষকেরা ব্যক্তিগতভাবে যদি চান তারা যেকোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারবেন। আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদটিকে একটা সুনির্দিষ্ট, সুবিন্যস্ত এবং বিস্তারিত আইন-কানুনের অধীনে নিয়ে আসা যেন তিনি তার খামখেয়াল অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতে না পারেন। আরো একটা জরুরি দিক ছিল সেটা হলো বিভাগীয় প্রধানের পদটাকে বিলুপ্ত করা হলো। সেখানে বিভাগ পরিচালনার ক্ষেত্রে এমন একটা ব্যবস্থা আনা হলো যে ব্যবস্থা অনুযায়ী বিভাগের প্রত্যেক শিক্ষক পালাক্রমে বিভাগের চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।  

প্রত্যেক চেয়ারপারসন তিন বছরের জন্য চেয়ারপারসন হিসেবে বিবেচিত হবেন। এখানে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরিগত জেষ্ঠ্যতা, সিনিয়িরিটি একমাত্র বিবেচনার বিষয় হবে মাপকাঠির হিসেবে। সেখানে কোন শিক্ষকের যোগ্যতা কেমন, কোন শিক্ষক কোন রাজনৈতিক দল করেন, কোন শিক্ষক কেমন না কেমন এগুলো কোনো প্রশ্ন বিবেচিত হবে না। বিবেচিত হবে শুধু যিনি সবচাইতে সিনিয়র তিনি বিভাগের সিনিয়রের দায়িত্ব পালন করবেন। তিন বছর পার হয়ে গেলে প্রায় সয়ংক্রিয়ভাবে তার পরের সিনিয়র ব্যক্তিটি বিভাগের চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করবেন। চেয়ারপারসনের হাতে দৈনন্দিন কার্যকলাপ পরিচালনা করার যে নির্বাহী দায়িত্বগুলো এগুলোই শুধুমাত্র থাকবে। বিভাগের নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো চেয়ারপারসন একা কিছুই করতে পারতেন না। বিভাগের ভেতরে দুইটি প্রধান বডি বা সংস্থা তৈরি হয় ৭৩ এর আইন অনুসারে। একটা হলো একাডেমিক কমিটি, আরেকটা হলো প্লানিং কমিটি।  

একাডেমিক কমিটি মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই বিভাগের সমস্ত শিক্ষক। আর প্লানিং কমিটি মানে ওই নির্দিষ্ট বিভাগের সব চাইতে সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত। কিন্তু প্লানিং কমিটির সদস্য সংখ্যা একাডেমিক কমিটির মোট সদস্যের এক তৃতীয়াংশের বেশি হতো না।  

 

সেলিম রেজা নিউটন : শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
  
চলবে....

শোনা থেকে লেখা : সাদিয়া মুমু

news24bd.tv/এসএম