ওপারে অপেক্ষায় রোহিঙ্গারা, ঠেকানো যাচ্ছে না অনুপ্রবেশ

ফাইল ছবি

ওপারে অপেক্ষায় রোহিঙ্গারা, ঠেকানো যাচ্ছে না অনুপ্রবেশ

দেলোয়ার হোসেন লিটু

গত ৮-৯ দিনে অন্তত ১৪ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। কমপক্ষে ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে তারা প্রবেশ করছে। মংডু এলাকা থেকে আসা রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছে বেশি। তাদের সহায়তা করছে টেকনাফের স্থানীয় দালাল চক্র।

এ চক্র রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর নৌকায় করে অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে গুণতে হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা।

জানা যায়, সীমান্তের দুই পাশেই রয়েছে এমন দালালচক্র। যাদের তৎপরতায় রাতের আঁধারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘটছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ।

আর আশ্রয় নিচ্ছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের কাছে অন্তত ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় আছেন বলে জানা গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশ যদি পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারে, তাহলে এই দফায় আরো এক লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা আছে।

দালালদের সহায়তায় মংডু থেকে টেকনাফে আসা সলিম উল্লাহ বলেন, রাখাইনে আরাকান আর্মি ও দেশটির সেনাবাহিনীর মধ্যেই তীব্র যুদ্ধ চলছে। তারা রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে আগুন দিয়েছে। গ্রামের অনেক রোহিঙ্গাকে তারা হত্যা করেছে। মর্টারশেল ও বিমান হামলা চালিয়ে অনেক গ্রাম তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে। তাই রাখাইনে খাদ্য সংকট সৃষ্টি হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে নৌকা করে নাফ নদ পার হয়ে টেকনাফের বড়ইতলী দিয়ে রাতের আঁধারে চলে আসতে বাধ্য হয়েছি। এ কাজে স্থানীয় লোকজন জনপ্রতি ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা করে নিয়েছে।

মিয়ানমারের মংডুর নলবুনিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ হানিফ (৫০)। মিয়ানমারে সংঘাতের জেরে গত ৮ আগস্ট পালিয়ে এসে এখন পরিবারের ৮ সদস্য নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন টেকনাফের ২৫ নম্বর ক্যাম্পে। তিনি বলছিলেন, কী কারণে পালিয়ে এসেছেন আর কীভাবে এসেছেন।

তিনি আরও বলেন, 'বোম মারে, গুলি মারে, এগুলো সহ্য করতে না পেরে আমরা এখানে এসে কষ্ট করে আছি। ১৩ জন এসেছিলাম, তার মধ্যে ৮ জন নৌকায় উঠতে পেরেছি, বাকি ৫ জনের কোন খোঁজ নেই। '

উখিয়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা ইউনুস আরমান বলেন," আমরা জানতে পেরেছি রাখাইন রাজ্যের মংডুতে চলমান যুদ্ধ তীব্র হচ্ছে। মংডু টাউনে থাকা সেনা ও বিজিপির দুটি ব্যারাক (ব্যাটালিয়ন) দখলের জন্য মরিয়া আরাকান আর্মি। গোলাগুলির পাশাপাশি দুই পক্ষ থেকে ছোঁড়া হচ্ছে মর্টার শেল, গ্রেনেড-বোমা। মাঝেমধ্যে ড্রোন হামলাও চালানো হচ্ছে। ”

রোহিঙ্গাদের ৯ নাম্বার ক্যাম্পের এক নাম্বার ব্লকের হেড মাঝি মোহাম্মদ হোসেন বলেন," প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা আসছেন। তারা নাফ নদীর পাশাপাশি অন্য সীমান্ত থেকেও আসছেন। স্থানীয় কিছু লোকজন তাদের বাংলাদেশে প্রবেশে সহায়তা করছে। তারা যে সবাই ক্যাম্পে আসছেন, তা নয়। ক্যাম্পের বাইরেও তারা অবস্থান করছেন। ”

তিনি আরও বলেন, "মংডুতে এখন যে তীব্র সংঘাত হচ্ছে, তাতে রোহিঙ্গারা আর সেখানে টিকতে পারছেন না। তারা মিয়ানমারের সামরিক জাস্তা এবং আরাকান আর্মি উভয়ের হামলা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ”

সীমান্তের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মি দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছে। আরাকান আর্মি ছয় মাস যুদ্ধে রাখাইনের অধিকাংশ অঞ্চল ও দেশটির সেনা ও বিজিপির ক্যাম্প, চৌকি দখলের পরে মংডু শহর দখল নিতে এখন তীব্র হামলা চালাচ্ছে। অন্যদিকে সরকারি বাহিনীও মংডু শহর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পাল্টা হামলা অব্যাহত রেখেছে। এ সংঘাতের জেরে মংডুসহ আশপাশের গ্রামে বসবাসরত রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে দালালদের সহায়তায় বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।

গত ৩ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সম্প্রতি বাংলাদেশে নতুন করে আট হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কথা জানান। তিনি জানান, "এটা কীভাবে ঠেকানো যায়, সেটা আমাদের চেষ্টা করতে হবে। ''

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘‘নীতিগতভাবে আমরা কোনো রোহিঙ্গাকে নতুন করে আশ্রয় দেবো না, যদিও দুঃখ লাগে কথাটা বলতে, কিন্তু আমাদের জন্য সাধ্যের অতীত, আর পারবো না তাদের আশ্রয় দিতে। ''

গত ২৮ আগস্ট অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গা মোহাম্মদ ইদ্রিস (৩৭) বলেন, ‘বার্মাতে একদল দালাল আছে, বাংলাদেশেও একদল দালাল আছে। বার্মায় নৌকায় তুলে দিতে দালালদের দিতে হয় ১০ হাজার টাকা আর বাংলাদেশে ঢুকলে এখানকার দালালদের দিতে হয় ২০ হাজার টাকা। ’

আরেক রোহিঙ্গা মোহাম্মদ ফরিদ বলেন, ‘৩০ হাজার টাকায় নৌকা ভাড়া করে বাংলাদেশে ঢুকতে হচ্ছে। আর শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন জানিয়েছে, নতুন করে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের নিয়ে সরকার থেকে যে নির্দেশনা আসবে তা বাস্তবায়ন করা হবে। ’

শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্তের জন্য তারা তাগাদা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এখনো নতুন রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি তাদের কাছে। ফলে নতুন রোহিঙ্গাদের নিয়ে তাদের কোনো উদ্যোগ নেই। ’

তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে নতুন করে যারা অনুপ্রবেশ করেছে তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আত্মীয় স্বজনের কাছে রয়েছে। যারা যুদ্ধে আহত হয়েছে তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। উপর থেকে নির্দেশনা আসলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। '

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা খবর পেয়েছি বাংলাদেশের কিছু দালালের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকছে। বিষয়টি নিয়ে বিজিবিসহ সবাইকে জানানো হয়েছে আরও কঠোর হওয়ার জন্য। ’

কক্সবাজারে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা নয়ন বলেন,"প্রতিদিনই ক্যাম্পে নতুন রোহিঙ্গা দেখা যাচ্ছে। এটা স্পষ্ট যে, সীমান্ত থেকে নতুন করে রোহিঙ্গারা ঢুকছে। তবে আমরা তাদের কোনো তালিকা করা এখনো শুরু করিনি। সরকারের কাছ থেকে আমরা এখনো এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা পাইনি। ”

মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক সামরিক অ্যাটাশে ও সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. শহীদুল হক বলেন, "রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে না পারলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। এমনিতেই তারা নানা সংকট তৈরি করছে ক্যাম্পে। সেখানে মাদক, অস্ত্র ব্যবসা হচ্ছে। নানা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আশ্রয় নিচ্ছে। ”

তিনি জানান, "এখনই এই সমস্যা সমাধানের হাইটাইম। সরকারের উচিত কূটনৈতিক তৎপরতা আরো জোরদার করা। আমরা আর কোনোভাবেই নতুন রোহিঙ্গা নিতে পারবো না। ”

news24bd.tv/DHL