মাঙ্কিপক্স ঝুঁকিতে বাংলাদেশ 

মাঙ্কিপক্স ঝুঁকিতে বাংলাদেশ 

আসিফ হাসান নবী

কভিডের পর এবার মাঙ্কিপক্স বা এমপক্স নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। মাঙ্কিপক্স বিশ্বের সামনে স্বাস্থ্য নিয়ে আরও এক বড় চ্যালেঞ্জ।  বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো জরুরি অবস্থা জারি করেছে। এর আগে ২০২২ সালেও একবার মাঙ্কিপক্সের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল।

আমরা উদ্বিগ্ন এ কারণে যে, ভারত এবং পাকিস্তানের কয়েকটি স্থানে ইতোমধ্যে এ রোগ ধরা পড়েছে এবং চিকিৎসা চলছে। তার অর্থ আমরাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি।

মাঙ্কিপক্সের ভাইরাস মূলত দুই প্রকার। ভাইরাস ১ এবং ভাইরাস ২।

বিশ্ব স্বাস্থ্য এবার উদ্বিগ্ন এ রোগের ভাইরাসের নতুন বৈচিত্র্য নিয়ে। যার নাম দেওয়া হয়েছে মাঙ্কিপক্স ভাইরাস ‘আইবি’। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগের তুলনায় বর্তমানে এ ভাইরাসের সংক্রমণের হার ১৬০ শতাংশ বেশি। মাঙ্কিপক্স মূলত পশুবাহিত রোগ। আমেরিকার ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পশু থেকে মানুষে কিংবা মানুষ থেকে মানুষে স্পর্শের মাধ্যমে ছড়াতে পারে এ রোগ। আশির দশকে প্রথম এ রোগের খোঁজ মেলে। মূলত পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকার দেশগুলোতেই এ রোগ সীমাবদ্ধ ছিল। যেসব পশুর শরীর থেকে এ রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা তাদের বাস মূলত গ্রীষ্মপ্রধান এলাকার বৃষ্টি বনাঞ্চল বা রেইন ফরেস্টে। চিকেনপক্সের মতো পক্সের ক্ষেত্রে কেবল গায়ে র‌্যাশ কিংবা ফুসকুড়ি বের হয়। কিন্তু মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রে সারা গায়ের পাশাপাশি, লসিকাগ্রন্থিতেও ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমণ। এ ভাইরাসের কারণে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। চিকিৎসকরা বলছেন, আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি থাকলে এই রোগে সংক্রমণের আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে। আক্রান্তের ক্ষত কিংবা দেহ তরলের সংস্পর্শে এসেছে, এমন জামাকাপড় থেকেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এ রোগ। যৌন সংসর্গ ছাড়াও শ্বাসনালি, ক্ষতস্থান, নাক, মুখ কিংবা চোখের মাধ্যমেও এ ভাইরাস প্রবেশ করতে পারে সুস্থ ব্যক্তির দেহে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

চলতি বছরের মে মাস থেকেই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এ রোগের সংক্রমণ। হু-এর পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বজুড়ে ৭৫টি দেশে ১৮ হাজারেরও বেশি মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত এ রোগে মৃত্যু হয়েছে ৫২৪ জনের। মাঙ্কিপক্স ঘিরে উদ্বেগ বাড়ছে ভারত এবং পাকিস্তানেও। ভারতের কেরালাসহ কয়েকটি প্রদেশে জারি হয়েছে বাড়তি সতর্কতা। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা খাইবার পাখতুনখাওয়ার এক বাসিন্দার শরীরে মাঙ্কিপক্সের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়েছে।

এ ভাইরাসটি গুটিবসন্ত রোগের ভাইরাসের মতো একই গোত্রের, কিন্তু অনেক কম মারাত্মক এবং বিশেষজ্ঞদের মতে এতে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনাও কম। এটি একটি ডিএনএ জাতীয় ভাইরাস এবং কভিড বা ফ্লু ভাইরাসের মতো সহজে বা দ্রুতগতিতে এর মিউটেশন বা রূপান্তর ঘটে না। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যারা মাঙ্কিপক্সে সংক্রমিত হচ্ছেন তাদের অনেকেই সমকামী বা উভকামী তরুণ বা যুবক। যৌনক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মাঙ্কিপক্স ছড়াচ্ছে এবং আক্রান্তদের বেশির ভাগেরই যৌনাঙ্গ এবং তার আশপাশের জায়গায় গুটি হতে দেখা যাচ্ছে। গবেষকরা জানাচ্ছেন, কেন সমকামী-উভকামী পুরুষরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন তা স্পষ্ট নয়। এটা কি শুধুই ঘটনাচক্রে এমন হচ্ছে, নাকি যৌন আচরণের ফলে ভাইরাসটি সহজে ছড়াতে পারছে, তাও স্পষ্ট নয়। তবে এটিকে আগে যৌন সম্পর্কবাহিত রোগ বলে চিহ্নিত করা হয়নি। কিন্তু বলা হচ্ছে যে যৌনমিলনের সময় ভাইরাসটি সরাসরি একজন থেকে আরেকজনের দেহে চলে যেতে পারে।

এ রোগ শনাক্ত হলে যে বিষয়টি প্রথমেই করতে হবে সেটা হলো- পরীক্ষা। জ্বর, ক্লান্তি, গা-ব্যথা, লসিকাগ্রন্থি ফুলে যাওয়া ও ত্বকে ক্ষত তৈরির মতো উপসর্গ দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয় বলে বিশেষজ্ঞদের মত। মাঙ্কিপক্সের উপসর্গ সাধারণত রোগ সংক্রমণের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দেখা যায়। কাজেই যদি এ ভাইরাসে আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে কেউ এসে থাকে তবে আগেভাগে আলাদা থাকা যেতে পারে। আলাদা থাকার পাশাপাশি, স্নানের গামছা, তোয়ালে পৃথক করতে হবে। একই খাটে শোয়া কিংবা একই পোশাক পরা থেকেও বিরত থাকতে হবে। যতক্ষণ না পরীক্ষার ফল হাতে আসছে, ততক্ষণ সতর্কতা হিসেবে এ পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি কী কী উপসর্গ দেখা দিচ্ছে তা জানাতে হবে চিকিৎসককে। আন্তর্জাতিক গবেষকরা বলছেন, গুটিবসন্তের টিকা নিলে তা মাঙ্কিপক্সের বিরুদ্ধেও ৮৫ শতাংশ সুরক্ষা দিয়ে থাকে, কারণ এ দুটি ভাইরাসের অনেক মিল আছে।

বাংলাদেশে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ ঠেকাতে দেশের সব বিমান ও স্থলবন্দরে সতর্কতা জারি করতে পারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আক্রান্ত দেশ থেকে আসা যাত্রীদের ওপর সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং স্ক্রিনিং জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া যেতে পারে। যাদের ফুসকুড়ি দেখা যায় এবং যিনি সম্প্রতি মাঙ্কিপক্স নিশ্চিত আছে এমন দেশগুলো ভ্রমণ করেছেন অথবা এমন কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন যিনি নিশ্চিত অথবা সন্দেহজনক মাঙ্কিপক্স রোগী হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন, এমন রোগীদের সন্দেহজনক রোগীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সন্দেহজনক ও লক্ষণযুক্ত রোগীকে কাছের হাসপাতালে বা সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালে আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক : বিশেষজ্ঞ