পালকের চিহ্নগুলো

অলংকরণ: কামরুল

কিস্তি-৩

পালকের চিহ্নগুলো

নাসরীন জাহান

আজ আমাদের ময়মনসিংহের পাড়ায় ফিরে যাই। আমাদের আকুয়া মাদ্রাসা কোয়ার্টারের বাসার বাঁ দিকের আমাদের মাঠ পেরিয়ে রেললাইন। নাসিরাবাদ স্কুলের পেছনের  ডানদিকের ছিপছিপে ফিগারের পাশের বাসাটার অরণ্য ঘেরা বাড়ির মালিক বাড়ি ফাঁকা রেখে কোথাও একটা থাকতেন।  একটা রাস্তা গেছে সোজা যেখানে বন্ধু ধীনা নাজলী ফুপু বাবুল কাকাদের বাড়ি।

ধীনা সব ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে সরল। আমি তিরাশি সালের পরে তাকে আর দেখিনি। দেশের বাইরে আছে, স্বামী সন্তান নিয়ে।  

 আরেকটা রাস্তা কোমর বাঁকিয়ে অনুদের নেটের  জানালা ধরে চলে গেছে একেবারে সোজা।

গলির মাথায়  আমার ছোটবেলার বন্ধু রেহানা আর ঝর্নার ছোটবেলার বন্ধু নাহারদের বাসা।
আগে সেটা আটপৌরে বাড়ি ছিল। এখন অট্টালিকা উঠেছে।   এরপর মূল রাস্তার অপরপাশেই পান্নু কাকাদের বাড়ি।  ডানদিক ঘেঁষে গোরস্থান। গাছগাছালি ঘেরা। ছায়াচ্ছন্ন।  আমি যতবার সেই গোরস্থান দেখতাম,হঠাৎ মনে হত,আব্বা আম্মা যদি না থাকেন?ছোট্ট বুকটায় ভূকম্প উঠত! কেন ওদিকে তাকালেই এমন বুক এঁফোড় ওফোঁড় করা বোধ আমাকে কাঁপাত,আমি জানি না।  আম্মাকে জড়িয়ে ধরতাম,আম্মা বলতেন,এইতো আছি। তুমি আর গোরস্থানের কাছে যেও না। যখন মাটির সাথে হাঁটার বয়স গলি ধরে হেঁটে শুনতাম, পান্নু কাকার হারমোনিয়াম,, মা,বোন বিহারি,,এমনই কিছু অর্থ দাঁড়াত সেই বয়সে আমার কানে। যতবার গলির মুখে দাঁড়াতাম,এক গান। একদিন দেখা হলে বললাম,আপনি আর কোন গান পারেন না?
তিনি হেসেই খুন!বলে তুই রবীন্দ্র সংগীত বুঝিস?সেই প্রথম রবীন্দ্র সংগীত বলে কোন এক সংগীতের নাম শোনা। এবং গানটা মা বোন বিহার নয়,মায়াবন বিহারিণী হরিণি ছিল।  
এরপর টানা ক দিন আরেকটা গান 
 ধরলেন। হারমোনিয়ামের প্যা প্যার সাথে  টানা কয়েকদিন।   আমার কানে সে  অর্থ দাঁড়াতে থাকল হে কনিকার  অতীত,,কনিকা নামের এক মেয়ে প্রাইমারিতে পড়ত। খুব বজ্জাত!   তবে এই হারমোনিয়ম আমার ঘরে থাকলে আধুনিক গান গেয়ে ফাটিয়ে দিতাম। যা গাইতাম তখন! পরে বুঝি,ওটা ছিল হে ক্ষণিকের অতিথি,,, কান্ড! পান্নু কাকার টানা দুটো গানের কারণে বহুদিন আমি রবীন্দ্রসংগীত পছন্দ করতাম না। পান্নুকাকার গলা খারাপ ছিল না। অর্থহীন একই আবেগ বর্জিত গান!!! কাহাতক?  এমনকী জাতীয় পত্রিকায় লেখালেখি যখন ছাপা হচ্ছে তখনও।  

রবীন্দ্র সংগীত প্রথম পছন্দ করি কলেজে উঠে সাগর সেন শোনার পরে।  এরপর দেবব্রত, বন্যা,মিতা,, যখন যাঁর কন্ঠে যেটা ভালো লেগেছে, সেটা। পান্নু কাকা একদিকে হিরো টাইপের  ছিলেন। তেমন পড়াশোনা ছিল না। কিন্তু আমাদের পিচ্চি সময়ে একটা সুন্দরী শিক্ষিত নারীকে ভাগিয়ে এনেছিলেন। একেবারে এভাবে প্রচারিত হয়েছিল পাড়ায়। আমার করাচি চাচী না পান্নুকাকার বউ কে বেশি  সুন্দর? তুলনা করতে পারতাম না। তবে আমার চাচী অহংকারী ছিলেন। পাড়ায় তখন  ছিলেন কী?পান্নু কাকার বউ আন্তরিক।  

বড় হতে হতে আমি তার বাড়ির ভেতরে গিয়ে মুগ্ধতায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। নান্দনিকভাবে বাড়ি সাজানো একেই বলে। একটা ড্রেসিং টেবিল এত সুন্দর ছিল, আমি যে কোনভাবে তার একটা ছবি তুলে বিয়ের পরে হুবহু বানিয়েছিলাম। আমি একটা পর্যায়ে পাগলের মতো ক্যাসেট কিনতাম,রেকর্ড করতাম এসব আগে লিখেছি। কিন্তু জীবনের প্রথম আমি পান্নু কাকার বাসায় শতশত ক্যাসেট অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখে চুরি করেছিলাম, বেশ'কটি। কালেভদ্রে বই চুরি ছাড়া ওই চুরিই ছিল আমার জীবনের একমাত্র চৌর্যকান্ড। যেহেতু স্বভাবে চুরি নেই,এ নিয়ে জীবনের বাঁকে বাঁকে প্রায়ই মনে পড়েছে।  কেন মনে পড়েছে,খচ লেগেছে জানি না। কিন্তু কেটেও গেছে এই ভেবে, ওসব ছিল অবহেলার ধন।
আমাদের কলেজ বা ভার্সিটি জীবনের বয়স যাকে বলে সেই বয়সে এদেশ বাখোয়াজ ছবি বানানো শুরু হয়। ফলে কোন নায়ক ক্রাশ ছিল না। এমনকী কলকাতার ছবিতে তখন প্রসেনজিৎ, তাপস পালও পছন্দ ছিল না। আসলে স্টোরি ভালো না হলে চরিত্রদের চেহারা এমনিই নষ্ট হয়ে যায়। ফলে বেছে বেছে ছবি দেখতাম। গানের ব্যাপারে আমার পুরানা আমল পছন্দ। আর ছবির ব্যাপারে ক্লাসিক বাদে আমি সময়ের সাথে চলা মানুষ।  তবে জমজমাট কমার্শিয়াল ছবিও যে এনজয় করি না তা নয়।  

আমাদের রাস্তাটা এখনও তেমনই ছিমছাম আছে।  বাড়িঘর কিছু বদলেছে। একটা কচুরিপানার পুকুর,কিছুদিন আগে অব্দি ছিল। আমাদের বাসায় একটা কান্ড হত। একসময় আমাদের গোসলের জায়গা বাইরে ছিল। আব্বা গোসলে গেলে ভরসা করে আমার কাছে প্যান্ট রেখে দিতেন। তিনি ঘুরে ঘুরে অপচয় করেন। সংসারের সবার তো পয়সা দরকার। কিন্তু আব্বা ভরসা করায় অসহায় আম্মাকেও আমি প্যান্টের পাশে ঘেঁষতে দিতাম না। আম্মা তো পয়সা টাকা যা-ই হোক,আমাদের জন্যই নিতে চাইতেন।  কিন্তু আমি  আব্বার ভরসা কীভাবে ভাঙি?
এই সংসার থেকেই আমরা সততা নিয়ে বড় হয়েছি।

বিদ্যাময়ী স্কুলের টিচার আমার মামীর কন্যা মানে আমার মামাতো বোন  ছিল দারুণ পরচর্চাকারী। এবং মোটা দাগে যাকে বলে হিংসুটে, ও তাই। গলির মোড়ের নেটের ওপাশে আমরা কেবল অনুর দুটো আঁধারাচ্ছন্ন চোখ দেখতে পেতাম। সেও ছিল মামাতো বোনের  ক্লাসমেট।   স্কুলে গেলেই সেই বলত,কীরে?তোদের বাসায় দিনরাত নাকি খালি ছেলেরা আসে? তুই তাদের সাথে কী করস?এইভাবে তোর বিয়ে হইব?
বুঝতাম, নেটপর্দার আড়ালের অনু সব তথ্য দিয়েছে আমার মামাতো বোনকে। পর্দানশিন সেই মেয়ে কীভাবে ওই দুটো অন্ধকার চোখ দিয়ে পাড়ার তথ্য রাখত,সে ছিল এক বিস্ময়! 
স্কুলে অন্য মেয়েদের সামনে যখন অনুর মাধ্যমের কথাগুলো শুনতাম,ক্ষোভে, কষ্টে জর্জরিত হয়ে যেতাম। আমি আজীবন দারুণ সেনসিটিভ। কেউ যাতে আমাকে ন্যুনতম অপমান করতে না পারে,তার জন্য অনেক সতর্ক হয়ে চলতাম।
কিন্তু যেহেতু সাহিত্যের ছেলে মেয়ে এলে আমার আব্বা আম্মার কোন সমস্যা ছিল না, আমি পরে এ নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাইতাম না। কিন্তু অনেক অনিদ্রার ছটফট রাত কেটেছে অনুর আরও কিছু বানোয়াট তথ্য সরবরাহের জন্য।  অথচ এই অনু শৈশবে আমাদের মাঠে এসে আমাকে ঝর্নাকে নাচ শেখাতে চাইত। মনে পড়ে ঘুরে ঘুরে ওড়না নিয়ে হাওয়ামে উড়তা যায়ে,মেরা লাল দু পাট্টা মলমল,, জীবনের প্রথম শোনা হিন্দি গান। অনু কোথায় পেয়েছিল? বড় হতে না হতেই সে পরিবারের কঠিন অনুশাসনে পর্দার আড়ালে চলে গেল। তবে অনু ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল। তার বাড়িতে একেবারে ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছাড়া সবার প্রবেশ  ছিল কঠিনভাবে নিষিদ্ধ।   বাবুল কাকাসহ আরও অনেকে ছিল যুদ্ধ পরবর্তী নকলের সময় পাশ করা। এরপর তাঁদের জীবনে আর পাশ আসেনি।

আমাদের ভাইবোনের মধ্যে সাংসারিক এত টানাপোড়েনের মধ্যেও দারুণ টান ছিল। কেবল বড়বোন স্বপ্না আর পিঠাপিঠি ভাই শিপনের সম্পর্ক ছিল টম এন্ড জেরীর মতো। সারাক্ষণ যুদ্ধ লেগে থাকত। আম্মাকে পটিয়ে অনেক কষ্টে ড্রয়িং রুমে একটা শোকেস বানিয়েছিলাম। যতবার তাদের ফাইট হয়,আমার বুক ভেঙে দিয়ে শোকেসের গ্লাস ভাঙা পড়ত। তারপরের ভাই আলোক। আত্মনিমগ্ন একজন মানুষ।  এরপর আমি,ঝর্না,,সবশেষে জুয়েল।   রান্নাঘরে দুপুরে সব ভাইবোন মিলে আম্মাকে ঘিরে খেতে বসার দৃশ্য খুব মনে পড়ে। আস্ত ডিম আবার কেউ খায় নাকি?আম্মার সুচারু ভাবে কেটে দেয়া ডিম ছোট আলুর তরকারি। অমৃত।
তিনভাই তিনবোন। আপা ছিল দারুণ স্মার্ট।  অসাধারণ সেলাইয়ের কাজ জানত। একবার সাধারণ সালোয়ারের যুগে সে আমাকে আর ঝর্নাকে চোস্ত পাজামা বানিয়ে দিয়ে বলে, সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকতে হবে না?তোদের দেখেই দেখবি সবাই বানাবে। এটা স্টাইল। বোনের ভয়ে আমি আর ঝর্না সেই চোস্ত পরে রাস্তায় যেন আর হাঁটতে পারি না লজ্জায়। অনেকেই আমাদের দেখে হাসত।

আমাদের পাড়ার টেলিভিশন ভাড়াটিয়া শাহাবুদ্দিন নানার  ছেলে বিজন এবং আরও কেউ কেউ আপার বন্ধু ছিল।  আপা তাদের সাথে লুকিয়ে স্মোক করত। পাড়ার অন্য সব ছেলের চাইতে অবশ্য বিজন অনেক ভদ্র ছিল। স্বপ্নার ছোটবোন হিসেবে আমি সবসময় অনুভব করতাম,সে আমাকে স্নেহের চোখে দেখে। তবে দিনের এই ক্যাজুয়াল বিজন রাতে পালটে যেত। যখন আমরা ঘামে ঘামে এক হয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। পুরো পাড়ায় অন্ধকারে ডুবে থাকত,তখন বিজন নিজেদের ছাদে বাঁশি বাজাতো। একেবারে রাখালিয়া বাঁশি। বাঁশি আমার ভেতরের সব বেদনা আনন্দ একেবারে উস্কে দিয়ে স্তম্ভিত করে দিত!
সেই বাঁশি আমাদের একঘেয়ে পাড়ায় স্পেশাল কিছু ছিল। লেখা শুরুর পর্যায়ে আপা আলেস্কান্দর বেলায়েভের উভচর মানুষ এনে পড়তে দিয়েছিল। পরবর্তী জীবনে আমার সাইন্স ফিকশনের প্রতি আর তেমন আগ্রহ জন্মায়নি। তবে সেই উভচর মানুষের বেদনা আমার লেখার ভিত তৈরি করতে সাহায্য করেছিল।
পরে জানতে পারি,আপা বইটা বিজনের কাছ থেকে এনেছিল। এক পুর্ণিমা রাতের কথা মনে পড়ছে।  প্রতি পুর্ণিমার মতো আমি উঠোনে বসে গাছের ছায়ায় আলোর প্লাবন দেখছিলাম। ভেতরটা শূন্য লাগছিল ঢাকায় চলে যাওয়া ভালোবাসার মানুষের জন্য।  এরমধ্যে কাছের এক ভরসার আত্মীয় আমাকে একা পেয়ে  খারাপ অভিপ্রায়ে  বুকে হাত দিয়েছিল।   সব নিয়ে যখন হাহাকারে ভাসছি। জোছনা, স্তব্ধতা ফুঁড়ে বাঁশি বাজতে থাকে।  আমি যেন চন্দ্রাহত হয়ে যাই। দরজা পেরিয়ে, রাস্তা , সিঁড়ি টপকে বিজনের পেছনে চুপ করে বসে থাকি।  

বিজনের সম্বিত ফেরে। আমাকে দেখে বলে, অত রাতে তুই এখানে?যা যা বাড়ি যা মানুষ খারাপ বলবে। কীভাবে সব পুরুষকে এক ছাঁচে ফেলি? বিজন সেই রাতে আমার ভেতর সম্মানীয় পুরুষের ছাপ রেখেছিল। কীভাবে ভুলব?  বিজন,তার একেবারে শৈশবের বন্ধু মীরা,তাদের আলাদা এক জগৎ ছিল।   আমাদের বইহীন পাড়ার মধ্যে থেকে একটা কিশোর বয়স আলোড়িত করা বই পেয়েছিলাম, সে ছিল আমার জন্য অনেককিছু। ওই বাঁশি ছাড়াও আমাদের জীবনে দারুণ আনন্দ নিয়ে এসেছিল আমার দুই মামার বিয়ে।  দু বিয়েতেই আমরা ছেলেমেয়ে খোলা ট্রাকে করে মামী নিয়ে নানা বাড়ি ফিরতে ফিরতে পুরো রাস্তায় হাততালি দিয়ে দিয়ে কত গান গেয়েছি! এরমধ্যে ছোট মামীর ভাই বাবু আমাদের সাথে একেবারে দারুণভাবে জড়িয়েছিল বছর বছর।  
 ট্রাকের ওপর হুহু বাতাস! আমরা গাইছি,সে যে কেন এল না,কিছু ভালো লাগে না,এবার আসুক তারে আমি মজা দেখাব! ইঞ্জিনিয়ার মীরার বিয়ে ঠিক হয়ে  তার প্রেমিকের সাথে।  বিজনও শপিং এ হেল্প করছে। বিয়ের তারিখের আগে আগে হঠাৎ মীরা বিজনের কাছে এল,তাদের মধ্যে কী কথা হল,কেউ জানে না। মীরা বিয়ে ভন্ডুল করে বিজনের সাথে জীবনে যুক্ত হয়ে দুজন দেশের বাইরে চলে গেল!

আমাদের পাড়ার নাম মাদ্রাসা কোয়ার্টার হওয়ায় আমার চিঠিবন্ধুরা ভাবত আমাদের বাবা মাদ্রাসায় কাজ করেন,এবং আমরা তাই কোয়ার্টারে থাকি।
কান্ড! স্বপ্নাপা,আমি ঝর্না আমাদের বন্ধুজগত নিয়ে বেশ ছিলাম। তবে ঝর্নার বন্ধুজগত আর আমার জগতে মাঝে মাঝেই এক হয়ে যেত। একসাথে সিনেমা,ঘুরতে যাওয়া, সব। আর শিপন আর আলোক ভাই তারা দুজন দুজনের বন্ধু ছিল। তাদের আলাদা কোন বন্ধু জগত ছিল না।
জুয়েল ছিল না ঘরকা না ঘাটকা। প্রেমিকাদের প্রেমের চিঠি আদান প্রদান ছিল তার মূল কাজ। আম্মা বাড়িতে গেলে সংসারের ভার পড়ত ঝর্না আর আমার ওপর  আমরা দুজন কাজ যাতে নিখুঁত সমান সমান হয়,বিছানার চাদরের কর্ণার ধরে, রান্না ঘরে সবজি দুজন সমান পরিশ্রমে ভাগ করে কাটতে  গিয়ে নানা কান্ড করে হেসে মরতাম। শিপন ভাই খুব অদ্ভুত ছিল।  আমরা হুজ্জত করছি,তার কোন খবর নেই। কিন্তু হঠাৎ তার চোখে পড়ল বই হাতে কোথাও যাচ্ছি,চিল্লিয়ে বলবে,কী করছিস?বাড়ি যা?
আমরা বন্ধুরা দলবেঁধে গোলাপি এখন ট্রেনে ছবির মধ্যে একেবারে মজে গিয়েছিলাম।   ইন্টারভ্যালে দেখি দূরে শিপন ভাই বসে আছে। অবশ্য আমরা ছবির কথা বাসায় বলে আসিনি,ফলে ভয় পাব কী পাব না,এমন কনফিউশান নিয়ে আসলে শিপন ভাইকে ভয় পেয়েই  হল থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।
পরে অবশ্য দেখেছি।

ঝর্নার ছোটবেলার বন্ধু নাহার ছিল শিপন ভাইয়ের দু চোখের বিষ। ঝর্না প্রাণের সখীর সাথে শিপন ভাইয়ের আড়ালে মিশত। কারণ দেখলেই ভাই লংকাকান্ড বাঁধাবে। এ নিয়ে ঝর্নার কষ্টের সীমা ছিল না। এভাবেই বেড়ে ওঠার পরে চাকরি পেয়ে শিপন ভাই আমার বাসায় এসে বলে , আমি একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছি,তুই কল্পনা করতে পারবি না,অসম্ভবকে দুম করে কল্পনা করতে পারি আমি,বলি নাহারকে বিয়ে করে ফেলেছ? কীভাবে বুঝলি তুই?এরপর চাকরি পেয়েই বিয়ে, শয্যাশায়ী আব্বার অবস্থা সম্পর্কে ভাবল না?এমন নানা কথাকে থামিয়ে আমি ময়মনসিংহ গিয়ে আম্মার সাথে তাঁদের বরণ করে নেয়ার কাজে লেগে পড়ি। সেই নাহার এরপর  কত সংসারী! কত আন্তরিক! কত অধিকারের সম্পর্ক আমাদের! 
আমি প্রায়ই তাদের বাসায় যেতাম। শিপন ভাইয়ের মায়া আমাকে প্রবলভাবে ছুঁয়ে যেত। একদিন আমি তখন প্রচন্ড অসুস্থ। বিছানা থেকে ওঠার অবস্থা নেই।

হঠাৎ  শিপন ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ পাই। মধ্যেরাতের স্ট্রোক। অথচ তার তেমন কোন অসুখ ছিল না। এদিকে প্রচন্ড কোমর ব্যথাসহ অন্যান্য অসুখে এমন মরণ যন্ত্রণা হচ্ছিল আমার! শারিরীক যন্ত্রণা তো হচ্ছিলই সাথে মানসিক যন্ত্রণার ভারে আমি নুব্জ হয়ে পড়েছিলাম।  
কাছেই বাড়ি,আমি নিজেকে তুলতে পারিনি।   ঝর্নার মনে মস্তিষ্কেও এই মৃত্যুর ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। আমি সেদিন কিছুতেই নিজেকে উঠিয়ে ভাইয়ের মুখ দেখতে যেতে পারি নি। আমার ওয়ান থেকে ক্লাস টেন অব্দি মূলত আমার পাড়ার জীবন। এই দশ বছর এনালগ যুগের সূক্ষ সব স্মৃতির সাথে উপলব্ধির সাথে বাকি জীবনের স্মৃতিও ধোপে টিকবে না। আমাদের বাসা ঘেরা প্রাকৃতিক বাড়িটি ছিল আমাদের হাঁপ ছাড়ার দারুণ এক জায়গা। সেখানের গাছের আম জাম প্রায়ই আমরাই খেতাম। মনে হত,অন্য কোন জগতে চলে এসেছি।
এই বাড়িটি ছিল আমার কৈশোর চোখের জানালা।  
একদিন মালিক এল। জানালার ওপর দেয়াল উঠতে থাকল। ও হ্যাঁ, একদিন পাড়ায় বাজ পড়ল। নকল মেট্রিক পাস বাবুল কাকার সাথে অনু ভেগে গিয়ে বিয়ে করেছে! কীভাবে বাবুল কাকা তার বাড়ি গেল,কীভাবে কী হল,আশ্চর্য! মানুষ বড় অদ্ভুত! আমার ভেতরটা আনন্দে ছেয়ে গেছিল! অস্থির হয়ে মামাতো বোনের কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করছিল। মনে হচ্ছিল এবার আমি গিয়ে শোনাব! মনে হচ্ছিল প্রকৃতি দারুণ একটা প্রতিশোধ নিল!

news24bd.tv/ডিডি