পালকের চিহ্নগুলো

অলংকরণ: কামরুল

কিস্তি-৪

পালকের চিহ্নগুলো

নাসরীন জাহান

পৃথিবীর মানুষ কেমন,  দেখতে হলে শিশুর চোখ দিয়ে দেখো, আমরা চক্ষুলজ্জার জন্য অনেক সময় বড়দের সামনে যা করি না,শিশুর সামনে নির্দ্বিধায় তা করি।
আমি শৈশবে যেসব আত্মীয় পরিচিতদের কাছ থেকে অনেক অবহেলা পেয়েছি,বড় হওয়ার পর তাদের আবেগ আপ্যায়ন ভেতর থেকে আমাকে তাদের কাছে নিতে পারেনি।   আমার বড় ফুপুর মেয়ে সম্ভবত পাঁচজন মেয়ে। এক ছেলে।

  যখনই তাদের বাড়ি কালেভদ্রে আব্বার কারণে যাওয়া পড়েছে,তারা যে এলিট,এই অনুভব প্রকাশ করে আমাকে কুঁকড়ে দিয়েছে।

ছোটফুপু নিজের জীবন যুদ্ধ নিয়ে অস্থির ছিলেন।
তাঁকেও ভয় পেতাম। কিন্তু সেই বয়সে তার ওখানে যাওয়ার সাহস হয়নি কারণ ক্লাস ফোরে ফুপুর বাড়ি থেকে ভালো রেজাল্ট করে ময়মনসিংহ ফিরে বাসায় বলেছিলাম,আমাকে দিয়ে ফুপু বাথরুম পরিস্কার করায়।


মফস্বলে তখন বাথরুম পরিস্কার করানো একটা নিকৃষ্ট কাজ ছিল।   এটা না বললে আমাকে ফের ঢাকায় ফিরতে হত।  ফলে ছোট ফুপুর বাড়ি কীভাবে যাই?তার কন্যা শিলা তখন মায়ের ভয়ে ভীতু। কিন্তু তার সাথে  শৈশব থেকে   এখনো সম্পর্ক  অসাধারণ।  ভালো নাম শবনম জাহান। সে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তার শ্বশুরবাড়ির কাছের আত্মীয়।  সে এমপি,এবং আওয়ামীলীগের মহিলা সাধারণ সম্পাদক।  আমরা ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়েই এখন অব্দি জড়িয়ে আছি। এর বাইরে একটা পর্যায়ে সেও আমাকে ডাকে না,আমিও যাই না। নইলে আমি রুবীর খালা রুবীর মামার বাড়ি গিয়ে উঠি?

ফলে আমার দুই ফুপু ঢাকায়  থাকলেও ভয়ে আমরা স্কুল জীবনে এসে তাদের বাসায় থেকে সাহিত্য অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া পত্রিকা অফিসে ঢুঁ দেয়া এসবের জন্য ওঠার কথা কল্পনা করতে পারতাম না।
 আমরা এসে উঠতাম মনিপুরী এলাকায় রুবীর  ছোট এবং বড় খালার বাসায়, খালাতো ভাইবোন   হারুভাই মনি আপার বাসায়। মনি আপা অসাধারণ মানুষ। হারু ভাই সাপ্তাহিক রোববারের ডাকসাইটে সাংবাদিক।  
হারু ভাই তখন যেমন আমাকে ভালোবাসতেন। এখনো তেমন।   সবচেয়ে বেশি উঠতাম রুবীর ছোটমামা কথাসাহিত্যিক রাহাত খানের বাসায়। সেখানে স্নিগ্ধনারী নীনা মামীর আপ্যায়ন ছিল অপূর্ব!  তাদের চার সন্তান অপু নিপু শুভ্র কান্তা,,, কান্তা শিল্পী এব্যার ভক্ত ছিল,শুরু বনিএম। ওদের বাড়িতেই ইংরেজি গান শুনে প্রথম মুগ্ধ হই। সারাদিন কোলাহল পরে যেই মামার ফেরার শব্দটুকু হত,সবাই যার যার পড়ার টেবিলে। আমি আর রুবী ভয়ে যে কোথায় কোথায় লুকাতাম। । কেবল মামীর ধীর সঞ্চালন।  

এরমধ্যে রাত হত। দেখতাম একটা ঘরে অনেক রাত অব্দি বাতি জ্বলছে।  জানতাম,নিজের স্টাডি রুমে রাত জেগে লিখছেন রাহাত খান।

পুরো আবহের গভীর প্রভাব পড়েছিল আমার ওপর। মনে হত,বড় হয়ে রাহাত খান হতে হবে।  নিজের একটা এমন স্টাডি রুমে বসে লিখতে না পারলে কীসের লেখক জীবন?
মামীর আপ্যায়ন অসাধারণ! একবার আমরা যখন ময়মনসিংহ ফিরে আসছি মামী  রুবী আর আমাকে একরকম জামা দিয়েছিলেন। আমার চোখ জলে ভরে গিয়েছিল।

এরপর রুবীর বড়খালার মেয়ে অসাধারণ সরল মণি  আপার বিয়ে হচ্ছিল রাহাত মামার বাড়ি থেকে।  আব্বা আমাদের নামিয়ে দিয়ে ফুপুর বাসায় চলে যান।
আমাদের এক সপ্তাহের প্ল্যান।  গান বাজনা হচ্ছে। হঠাৎ লক্ষ করি,একটা চশমা পরা ফর্সা ছেলে এদিক ওদিকে থেকে আমার ছবি তুলেই যাচ্ছে। সচেতন হতেই বাড়ির ভেতর চলে যাই।

শুরু হয়ে যায়। যখন যেখানে যাই,ভিড়ের মধ্যে দিব্যি এসে হাজির। সূযোগ পেলেই ছবি তোলে।  আমাকে আর রুবীকে উলটো কথা বলতে শুনে বারবার সেও উলটো বলতে শুরু করে, মিতু বখু টইসু। এই কথাটা বলে বলে কান ঝালাপালা করে গেছে সারাক্ষণ।  কখনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে ইশারায় আমার সৌন্দর্যের, আমার এড়িয়ে চলার নানারকম বিবরণ দিতে   থাকে।  অবশ্য বিয়ের মধ্যে এমন এক আধটা টাংকি মারতে মন্দ লাগার কথা না। কিন্তু আমার প্রকৃতিটাই ছিল এমন, ভেতরে মজা পেলে,,ভালোলাগলেও ওপরে নির্বিকার চেহারা দেখাতে ভালো লাগত।
কিন্তু এই ছেলে তো ব্রত গ্রহণ করেছে পুরো বিয়ের অনুষ্ঠান আমার পেছনে ঘুরে কাটিয়ে দেবে! 

বরযাত্রী যাওয়া আসায় সাঁই করে সেই ছেলে  একই গাড়িতে উঠে যায়। উদ্যেশ্যমূলক গান ছেড়ে দেয়। এক সময় আমি টের পাই,মামাদের পাশের বাসাটাই তাদের। একমাত্র ছেলে, নাম জ্যোতি।   গায়ে হলুদ, বিয়ে, পরদিন বৌভাত। এরমধ্যে আমরা রোজ বাড়ির সামনে ব্যাডমিন্টন খেলতাম। ওপাশের দোতলা থেকে জ্যোতি আমাকে সাপোর্ট করে যেত।
অনুভব করলাম,আমার ভেতর বুদবুদ উঠছে। ভালোলাগা কাজ করছে।  রুবী জ্যোতিকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে।  এ নিয়ে চাপা ফিসফাস উঠছিল। পরদিন জ্যোতি সবার সাথে ফাইনাল করল উত্তম সুচিত্রার ছবি দেখতে যাবে। আমাকে বারবার ইশারা করলে আমিও মাথা নাড়ালাম।

কিন্তু আব্বা পরদিন  সকালে আমার খোঁজ নিতে এলে আমি হুট করে কাপড় চোপর গুছিয়ে মনি আপা, মামী রুবীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ময়মনসিংহ চলে আসি। জ্যোতি টুঁ শব্দটিও জানতে পারে না।

ময়মনসিংহ ফিরে ঘুমুতে গিয়ে অনুভব করি, বুক ধড়ফড় করছে। জ্যোতি টাংকি মারছিল না,অল্প সময়ের মধ্যেই মহা সিরিয়াস হয়ে উঠছিল। আমি অনুভব করেই ছবি দেখা,বৌভাত সব জম্পেশ প্রোগ্রাম ফেলে চলে আসেছি!

বারবার মনে হচ্ছিল,যখন সে টের পাবে, তখন কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তার? কত সব আনন্দময় প্রোগ্রাম ছেড়ে হুট করে চলে এলাম?পরক্ষণেই মনে হল,যা হয়েছে ভালো হয়েছে।
এসব বিষয় এগোতে না দেয়া ভালো। এ ছাড়া রাহাত মামা,হারু ভাই,তাদের একটা প্রেস্টিজ আছে না?আমার জন্য কেন নষ্ট হতে দেব?

ঘুমিয়ে পড়ি। রুবী ঢাকায়। পরদিন সকালে 
রাস্তায় উদ্যেশহীনভাবে হাঁটতে গিয়ে বাঁকে দাঁড়িয়ে চমকে যাই। আতা কাকাদের বাসার সামনে জ্যোতি দাঁড়িয়ে আছে!  অবিশ্বাস্য! কীভাবে? 

আমি কিছুক্ষণ স্থবির থেকে ইউটার্ন নিয়ে বাসার দরজায় ধাক্কা দিতেই আমার পেছন পেছন সে এসে আমাদের ড্রয়িং রুমে ঢোকে পড়ে। আম্মা হতবাক।  
ধীরে ধীরে জানতে পারি আতা কাকা তাদের নানা বাড়ি সূত্রে আত্মীয় হয়। সে আমাকে পরদিন না দেখে যেভাবে হোক রুবীর কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে এখানে এসেছে।  
অন্যান্য ভাইবোন আসে। বলে সামনে তোমাদের লম্বা জীবন পড়ে আছে। এখন এসব কী?
জ্যোতি বলে, তাহলে ও প্রমিজ করুক,সামনের লম্বা জীবনে অন্য কারো সাথে জড়াবে না।
আমি পাশ টাশ করেই তাকে বিয়ে করব।

কী অবস্থা! 
এরমধ্যে আতা কাকাদের পরিবার যুক্ত হয়ে যায়। ময়মনসিংহের কোথায় তাদের আলীশান নানার বাড়ি,তার দাদা কত বড়  
বাদশাহ,,এইসবের চর্চা যখন এসে ঠেকে এই জায়গায়, ধনী,ইঞ্জিনিয়ার ছেলে  তাই বিউটি ফাঁদ পেতে জ্যোতিকে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ অব্দি টেনে এনেছে। আমি জ্যোতিকে রীতিমতো ঘর থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিই। এটাই কাল হয়। জ্যোতি মরিয়া হয়ে ওঠে।  
আর আমি এই জায়গায় পুরোপুরি ম্যাচুরিটি দেখাতে পারিনি। আমার মনে হচ্ছিল,এদের চৌদ্দগোষ্ঠিকে জানানো দরকার, দেখানো দরকার, আমি কারো বাড়ির রাজপুত্রকে টেনে আনার মানুষ না।  
বরং তাদের ছেলে উলটো কীভাবে হন্যে হয়ে আমার পেছন ঘুরছে, এটা প্রমাণ না করা পর্যন্ত আমার শান্তি হচ্ছিল না।
জ্যোতি সেটা জানতে পেরে আতা কাকা সহ ময়মনসিংহ আর তার যা গোষ্ঠী সবাইকে ত্যাগ করে আমাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়।
এরমধ্যে আমার স্কুল আমার চাঁদের হাট,
ফ্যামিলি ক্রাইসিসের সাথে নিজেকে ক্রমাগত যুক্ত রাখা,এসব বেশ চলছিল।

সে যখন সব ছেড়ে আমাদের দরজা নক করে, আমি বাড়িতে বলে দিই,কিছুতেই যেন সে কপাট ক্রস করতে না পারে।

  সে ক,দিন পর পর চলে আসে। আমাকে না পেয়ে রুবীকে  কনভিন্স করার চেষ্টা করতে থাকে। মানুষ নিজেকে খুব ভালোবাসে। ফলে তাকে কেউ প্রচন্ডভাবে চাইলে ভালোবাসা তৈরি হয়। শুরুর দিকে 
আমারও জন্ম নিচ্ছিল।
এটাই টের পেয়ে গিয়েছিল সে,যতই আমি তাকে অগ্রাহ্য করি,তাকে অপছন্দ করি না। কিন্তু তার এই মাত্রাতিরিক্ত আসা যাওয়া, সে ভেবেছিল,আমি সারেন্ডার করব।  

কিন্তু তার এই বেপোরোয়া আচরণ  আমাকে ক্রমশ  অসহিষ্ণু করে তুলতে থাকে। কারণ আমি জানতে পারি,তাদের ময়মনসিংহ আত্মীয়দের মাধ্যমে ঢাকায় তার বাড়িতেও এই খবর পৌঁছে গেছে, ময়মনসিংহের একটা গরীব মেয়ের প্রলোভনে পড়েছে তাদের ছেলে।  
এই কথা আমি ঢাকায় ছোট ফুপুর বাসায় গিয়ে জানতে পারি।
আমার ক্রোধ ক্রমশ বাড়তে থাকে।  

 জ্যোতির অভিজ্ঞতা এমন  ছিল, সে সবসময় তার পেছনে মেয়েদের ছুটতে দেখেছে,আমি একেবারে বিপরীত। এটাই তাকে একেবারে অস্থির করে তুলছিল।
অবশ্যই সে ভালোবেসেছিল। কয়েকবার বলেছে,বাড়ি থেকে প্রস্তাব এনে আমাকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে।  
একেক সময় প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হয়ে মনে হত, বিয়ে করে দেখিয়ে দিই সবাইকে।  কিন্তু নিজেকে ক্রমশ শান্ত করতাম।  সে বুঝত,সে সাহিত্যের জগতের বাইরের মানুষ, এটাই আমার মূল আপত্তি।  সে বলত,তাদের বাড়িতে  বিখ্যাত লেখকদের বইয়ের সেলফ আছে। তার বাবা খুব পড়ুয়া। সেও সেসব বই পড়ে লেখালেখির চেষ্টা করছে।  কতগুলো ফানি কবিতাও সে পোস্ট করে আমাকে পাঠিয়েছিল।
কমিটমেন্টের ব্যাপারে আমি আজীবন সিরিয়াস। আমি জানতাম,আমি একবার যদি তার দিকে হেলে পড়ি,একবার ইয়েস বললে আমার ফেরার কোন পথ থাকবে না।
 সে সম্ভবত থার্ড ইয়ারে ফেল করে।  

তখন আমি ছোট ফুপুর বাসায় এসেছি ফুপাতো বোন শিলার বিয়ের অনুষ্ঠানে।   আমরা সপ্তাহখানেক আগে চলে এসেছিলাম।   তখন যোগাযোগবিহীন অবস্থায় কার কাছে কীভাবে জেনে যেন সে ফুপুর বাসায় চলে আসে। আমাদের বাসায় কেউ কিন্তু এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র আমাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেনি। ধনী,ইঞ্জিনিয়ার, এসব কারণে আমাদের পরিবার একবারও তাকে জীবনে গ্রহণ করার কথা বলেনি।

ফুপুর বাসায় তখন আব্বাও ছিলেন। সে এসে তাঁদের কাছেই  কাতর মিনতি জানায়,আমি যেন একবার তার বাসায় যাই। তার মা আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে। ছোটফুপু হইচই করে আব্বাকে বলেন,তোমার মেয়ের মাথায় কোন ঘিলু নাই?এমন ছেলেকে কেউ হাতছাড়া করে? 
আব্বা ঠান্ডা কন্ঠে বলেন,যাও তুমি ঘুরে এসো,এরপর তোমার সিদ্ধান্তই ফাইনাল হবে।   রাজী হই। তাদের বাড়িতে গিয়ে অন্তত নিজে খুলে বলতে পারব মূল ব্যাপারটা কী হয়েছে?
আমি শিলা ঝর্না আরও কে যেন ওদের জাহানারা গার্ডেনের বিশাল বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করি। তখন তারা আর সেগুন বাগিচায় থাকত না।

বিশাল সজ্জিত বাড়ি। প্রথম দেখা হয়,তার ব্যারিস্টার বাবার সাথে। চমৎকার ব্যবহার। আমার সাহিত্যচর্চার কথা তিনি জ্যোতির কাছেই শুনেছেন। তিনি আমাকে তাঁদের লাইব্রেরী রুম থেকে সুনীল আর শীর্ষেন্দুর দুটো বই উপহার দেন। কিন্তু অধ্যাপক মা ছিলেন গম্ভীর।   ছেলে ক্লাসে ফেল করেছে,একটা মেয়ের জন্য , তিনি নিতে পারছিলেন না।  আমি ধীরকন্ঠে বলি,আপনি দেখা করতে চেয়েছেন,তাই এসেছি।
তিনি কী বুঝে আমাকে অভিযোগ না করে ভিন্ন প্রশ্ন করলেন, ,তুমি জ্যোতিকে এড়িয়ে যাচ্ছ কেন?
আমি বললাম, আমার এড়িয়ে যাওয়ার অধিকার নেই?কী শুরু করেছে আপনার ছেলে? আমি তো আপনাদের নানারকম আত্মীয়ের কারণে অস্থির হয়ে আছি।

আমি টের পাই,প্রচন্ড ইগোতে লেগেছে তাঁর। তিনি  অসহিষ্ণু হয়ে  বলেন,কী মনে কর,আমার ছেলে তোমার যোগ্য না?
আমি বলি,আমি এমন কথা বলেছি?কিন্তু আপনিই চিন্তা করে দেখুন,একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখা হওয়ার পর থেকে আপনার ছেলে যেভাবে ঢাকা ময়মনসিংহ এক করছে, আমার প্রেস্টিজ নেই?আপনাদের আত্মীয়রা জোট বেঁধে বলে যাচ্ছে,আমি উস্কাচ্ছি, আমাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ দেখে আপনার ছেলেকে,,,। আমি এখন বুঝতে পারি,এই জ্যোতির প্রেমে যদি আমি পড়তাম, তার মা ডেকে পাঠালে, তিনি কথা শোনালে আমার কন্ঠ থেকে স্বর বেরোত?
থ্যাংক গড।

যা হোক,তিনি আস্তে করে আমার মাথায় হাত রেখে বলেন,এখন আমি জ্যোতির বিষয়টা বুঝতে পারছি।

আমরা তখন অন্য একটা ঘরে ছিলাম।  
তিনি বলেন, তুমি ওকে জাস্ট কথা দাও,ও পাশ করার পরে ওকে বিয়ে করবে। বাকিটা আমি বুঝে নেব। এই বলে বলে তিনি জ্যোতির অসাধারণ ব্যালকনিতে আমাকে দাঁড় করিয়ে আমার কাছে জ্যোতিকে পাঠিয়ে দেন। চারপাশে ফুলের বাগান। মনে হচ্ছিল অন্য কোন জগতে এসে পড়েছি! মনে হচ্ছিল,এই রাজ্যে ক্রমশ আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে।   জ্যোতি বলে , এখন তো আম্মু রাজি,এই ব্যালকনিটা কিন্তু  তোমার।  
মনে হচ্ছিল পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে।  
এই ছেলেকে বিয়ে করলে আমার ব্যক্তিত্ব বলে এক পর্যায়ে আর কিচ্ছু থাকবে না। আমাদের ফ্যামিলি কোনদিন এঁদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।
সামনে মেট্রিক্স পরীক্ষা। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর প্রশ্নই ওঠে না।

মোদ্দা কথা ওকে বিয়ে করলে আমার সাহিত্যের বারোটা বেজে যাবে।  শুরু থেকেই এই অনুভব ছিলো। তাদের বাড়ি গিয়ে তা চূড়ান্ত হয়।
ফলে আমি তার মার শিখিয়ে দেয়া কোন কথা না বলে, যেভাবেই হোক ওকে পাশ কাটিয়ে আমি চলে আসি।

এই ঘটনা এত বিস্তারে এজন্যই লিখলাম, এই একটা অধ্যায় আমার ম্যাচুরিটি কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করার কৌশল
আমি অনেকটা এই অধ্যায়ের পরে শিখেছি।

এরপরও জ্যোতি যখন কিছুতেই হাল ছাড়তে রাজী নয়,আমি  ঢাকায় এসে আশরাফের সাথে সাহিত্যালাপে,অনুভবে  মুগ্ধ হই,আগেই লিখেছি,আশরাফ আমাদের সাথেই ময়মনসিংহ চলে আসে। আশরাফের সাথে জীবন চলার সিদ্ধান্ত নিতে আমার একেবারেই অল্প সময় লেগেছে।   আব্বা আম্মা তাকে পছন্দ করলে আমি তাকে বিয়ে করার কথা চূড়ান্ত করে ফেলি।

এটা ছিল জ্যোতির জন্য বিশাল এক ধাক্কা।  আমি আর পেছন ফিরে তাকাইনি। আশরাফের সাথে চলতে গিয়ে অনুভব করি, কতটা সঠিক ছিল আমার সিদ্ধান্ত। আশরাফের প্রেমে পাগলামি যেমন ছিল,তেমন ছিল ম্যাচুরিটি। আমরা সাহিত্যের নানা শাখা প্রশাখা নিয়ে কথা বলে ঘন্টার পর ঘন্টা পার করতাম।
এখনো করি। দীর্ঘ দাম্পত্যের একটা পর্যায়ে কথা ফুরিয়ে যাওয়া একটা দারুণ ক্রাইসিস।   আমাদের মাঝখানে সাহিত্য আছে বলেই আমাদের কথা এখনো ফুরায় না।

( ক্রমশ )
লেখক পরিচিতি: নাসরীন জাহান : কথাসাহিত্যিক। কবিতাও লিখছেন কয়েকবছর থেকে। পুরস্কার পেয়েছেন ফিলিপ্স সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪) (উড়ুক্কু উপন্যাসের জন্য)। আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৫) (পাগলাটে এক গাছ বুড়ো গল্পের জন্য),বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন।   নাসরীন জাহান ১৯৬৪ সালে ৫ মার্চ বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাটে জন্মগ্রহণ করেন।  ব্যক্তিগত জীবনে নাসরীন জাহান কবি আশরাফ আহমেদের স্ত্রী। লেখালেখির সূত্রেই তার সাথে পরিচয় এবং সে থেকে প্রণয়। ১৯৮৩ সালে তারা বিয়ে করেন। তাদের এক মেয়ে। নাম অর্চি অতন্দ্রিলা।

news24bd.tv/ডিডি

এই রকম আরও টপিক